শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা: নবম অধ্যায় – রাজবিদ্যা-রাজগুহ্য-যোগ
(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)
শ্রীভগবানুবাচ –
ইদন্তু তে গুহ্যতমং প্রবক্ষ্যাম্যনূসয়বে।
জ্ঞানং বিজ্ঞানসহিতং যজ্ জ্ঞাত্বা মোক্ষ্যসেহশুভাৎ।।১
জ্ঞানং বিজ্ঞানসহিতং যজ্ জ্ঞাত্বা মোক্ষ্যসেহশুভাৎ।।১
অর্থঃ- (১) শ্রীভগবান্ কহিলেন – তুমি অসূয়াশূন্য, দোষদর্শী নও। তোমাকে এই অতি গুহ্য বিজ্ঞানসহিত ঈশ্বরবিষয়ক জ্ঞান কহিতেছি, ইহা জ্ঞাত হইলে তুমি সংসারদুঃখ হইতে মুক্ত হইবে।
শিষ্য শ্রদ্ধাহীন এবং দোষদর্শী হইলে গুরু তাহাকে গুহ্য বিষয় উপদেশ দেন না। কিন্তু অর্জ্জুন সেরূপ নহেন। তিনি গুহ্য বিষয় শ্রবণের অধিকারী, ‘অসূয়াশূন্য’ শব্দে তাহাই প্রকাশ পাইতেছে।
রাজবিদ্যা রাজগুহ্যং পবিত্রমদমুত্তমম্।
প্রত্যক্ষাবগনং ধর্ম্ম্যং সুসুখং কর্ত্তুমব্যয়ম্।।২
প্রত্যক্ষাবগনং ধর্ম্ম্যং সুসুখং কর্ত্তুমব্যয়ম্।।২
অর্থঃ- (২) ইহা রাজবিদ্যা, রাজগুহ্য অর্থাৎ সকল বিদ্যা ও গুহ্য বিষয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ; ইহা সর্ব্বোৎকৃষ্ট, পবিত্র, সর্ব্বধর্ম্মের ফলস্বরূপ, প্রত্যক্ষ বোধগম্য, সুখসাধ্য এবং অক্ষয় ফলপ্রদ।
অশ্রদ্দধানাঃ পুরুষা ধর্ম্মস্যাস্য পরন্তপ।
অপ্রাপ্য মাং নিবর্ত্তন্তে মৃত্যুসংসারবর্ত্মনি।।৩
অপ্রাপ্য মাং নিবর্ত্তন্তে মৃত্যুসংসারবর্ত্মনি।।৩
অর্থঃ- (৩) হে পরন্তপ, এই ধর্ম্মের প্রতি শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তিগণ আমাকে পায় না; তাহারা মৃত্যুময় সংসার-পথে পরিভ্রমণ করিয়া থাকে।
ময়া ততমিদং সর্ব্বং জগদব্যক্তমূর্ত্তিনা।
মৎস্থানি সর্ব্বভুতানি ন চাহং তেষ্ববস্থিতঃ।।৪
মৎস্থানি সর্ব্বভুতানি ন চাহং তেষ্ববস্থিতঃ।।৪
অর্থঃ- (৪) আমি অব্যক্ত স্বরূপে এই সমস্ত জগৎ ব্যাপিয়া আছি। সমস্ত ভূত আমাতে অবস্থিত, আমি কিন্তু তৎসমুদয়ে অবস্থিত নহি।
ন চ মৎস্থানি ভূতানি পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্।
ভূতভৃন্ন চ ভূতস্থো মমাত্মা ভূতভাবনঃ।।৫
ভূতভৃন্ন চ ভূতস্থো মমাত্মা ভূতভাবনঃ।।৫
অর্থঃ- (৫) তুমি আমার ঐশ্বরিক যোগদর্শন কর। এই ভূতসকলও আমাতে স্থিতি করিতেছে না; আমি ভূতধারক ও ভূতপালক, কিন্তু ভূতগণে অবস্থিত নহি।
যথাকাশস্থিতো নিত্যং বায়ুঃ সর্ব্বত্রগো মহান্।
তথা সর্ব্বাণি ভূতানি মৎস্থানীত্যুপধারয়।।৬
তথা সর্ব্বাণি ভূতানি মৎস্থানীত্যুপধারয়।।৬
অর্থঃ- (৬) যেমন সর্ব্বত্র গমনশীল মহান্ বায়ু আকাশে অবস্থিত, সেইরূপ সমস্ত ভূত আমাতে অবস্থিত ইহা জানিও।
সর্ব্বভুতানি কৌন্তেয় প্রকৃতিং যান্তি মামিকাম্।
কল্পক্ষয়ে পুনস্তানি কল্পাদৌ বিসৃজাম্যহম্।।৭
কল্পক্ষয়ে পুনস্তানি কল্পাদৌ বিসৃজাম্যহম্।।৭
অর্থঃ- (৭) হে কৌন্তেয়, কল্পের শেষে (প্রলয়ে) সকল ভূত আমার ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিতে আসিয়া বিলীন হয় এবং কল্পের আরম্ভে ঐ সকল পুনরায় আমি সৃষ্টি করি।
প্রকৃতিং স্বামবষ্টভ্য বিসৃজামি পুনঃ পুনঃ।
ভুতগ্রামমিমং কৃৎস্নমবশং প্রকৃতের্বশাৎ।।৮
ভুতগ্রামমিমং কৃৎস্নমবশং প্রকৃতের্বশাৎ।।৮
অর্থঃ- (৮) আমি স্বীয় প্রকৃতিকে আত্মবশে রাখিয়া স্বীয় স্বীয় প্রাক্তন-কর্ম নিমিত্ত স্বভাববশে জন্মমৃত্যুপরবশ ভূতগণকে পুনঃ পুনঃ সৃষ্ট করি।
ন চ মাং তানি কর্ম্মাণি নিবধ্নন্তি ধনঞ্জয়।
উদাসীনবদাসীনমসক্তং তেষু কর্ম্মসু।।৯
উদাসীনবদাসীনমসক্তং তেষু কর্ম্মসু।।৯
অর্থঃ- (৯) হে ধনঞ্জয়, আমাকে কিন্তু সেই সকল কর্ম্ম আবদ্ধ করিতে পারে না। কারণ, আমি সেই সকল কর্ম্মে অনাসক্ত, উদাসীনবৎ অবস্থিত।
ময়াধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়তে সচরাচরম্।
হেতুনানেন কৌন্তেয় জগত্ বিপরিবর্ত্ততে।।১০
হেতুনানেন কৌন্তেয় জগত্ বিপরিবর্ত্ততে।।১০
অর্থঃ- (১০) হে কৌন্তেয়, আমার অধিষ্ঠানবশতঃই প্রকৃতি এই চরাচর জগৎ প্রসব করে, এই হেতুই জগৎ (নানারূপে) বারংবার উৎপন্ন হইয়া থাকে।
অবজানন্তি মাং মুঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্।
পরং ভাবমজানন্তো মম ভুতমহেশ্বরম্।।১১
পরং ভাবমজানন্তো মম ভুতমহেশ্বরম্।।১১
অর্থঃ- (১১) অবিবেকী ব্যক্তিগণ সর্ব্বভূত-মহেশ্বর-স্বরূপ আমার পরম ভাবনা জানিয়া মনুষ্য-দেহধারী বলিয়া আমার অবজ্ঞা করিয়া থাকে।
মোঘশা মোঘকর্ম্মাণো মোঘজ্ঞানা বিচেতসঃ।
রাক্ষসীমাসুরীঞ্চৈব প্রকৃতিং মোহিনীং শ্রিতাঃ।।১২
রাক্ষসীমাসুরীঞ্চৈব প্রকৃতিং মোহিনীং শ্রিতাঃ।।১২
অর্থঃ- (১২) এই সকল বিবেকহীন ব্যক্তি বুদ্ধিভ্রংশকারী তামসী ও রাজসী প্রকৃতির বশে আমাকে অবজ্ঞা করিয়া থাকে। উহাদের আশা ব্যর্থ, কর্ম্ম নিস্ফল, জ্ঞান নিরর্থক এবং চিত্ত বিক্ষিপ্ত।
মহাত্মানস্তু মাং পার্থ দৈবীং প্রকৃতিমাশ্রিতাঃ।
ভজন্ত্যনন্যমনসো জ্ঞাত্বা ভূতাদিমব্যয়ম্।।১৩
ভজন্ত্যনন্যমনসো জ্ঞাত্বা ভূতাদিমব্যয়ম্।।১৩
অর্থঃ- (১৩) কিন্তু হে পার্থ, সাত্ত্বিকী প্রকৃতি-প্রাপ্ত মহাত্মগণ অনন্যচিত্ত হইয়া আমাকে সর্ব্বভূতের কারণএবং অব্যস্বরূপ জানিয়া ভজনা করেন।
সততং কীর্ত্তয়ন্তো মাং যতন্তশ্চ দৃঢ়ব্রতাঃ।
নমস্যন্তশ্চ মাং ভক্ত্যা নিত্যযুক্তা উপাসতে।।১৪
নমস্যন্তশ্চ মাং ভক্ত্যা নিত্যযুক্তা উপাসতে।।১৪
অর্থঃ- (১৪) তাঁহারা যত্নশীল ও দৃঢ়ব্রত হইয়া ভক্তিপূর্ব্বক সর্ব্বদা আমার কীর্ত্তন এবং বন্দনা করিয়া নিত্য সমাহিত চিত্তে আমার উপাসনা করেন।
জ্ঞানযজ্ঞেন চাপ্যন্যে যজন্তো মামুপাসতে।
একত্বেন পৃথক্তেন বহুধা বিশ্বতোমুখম্।।১৫
একত্বেন পৃথক্তেন বহুধা বিশ্বতোমুখম্।।১৫
অর্থঃ- (১৫) কেহ জ্ঞানরূপ যজ্ঞদ্বারা আমার আরাধনা করেন। কেহ কেহ অভেদ ভাবে (অর্থাৎ উপাস্য-উপাসকের অভেদ চিন্তাদ্বারা), কেহ কেহ পৃথক্ ভাবে অর্থাৎ (দাস্যাদি ভাবে), কেহ কেহ সর্ব্বময়, সর্ব্বাত্মা আমাকে নানা ভাবে (অর্থাৎ ব্রহ্মা, রুদ্রাদি নানা দেবতারূপে) উপাসনা করেন।
অহং ক্রতুরহং যজ্ঞঃ স্বধাহমহমৌষধম্।
মন্ত্রহহমহমেবাজ্যমহমগ্নিরহং হুতম্।।১৬
মন্ত্রহহমহমেবাজ্যমহমগ্নিরহং হুতম্।।১৬
অর্থঃ- (১৬) আমি ক্রতু, আমি যজ্ঞ, আমি স্বধা, আমি ঔষধ, আমি মন্ত্র, আমিই হোমাদি-সাধন ঘৃত, আমি অগ্নি, আমিই হোম।
পিতাহমস্য জগতো মাতা ধাতা পিতামহঃ।
বেদ্যং পবিত্রমোঙ্কার ঋক্ সাম যজুরেব চ।।১৭
বেদ্যং পবিত্রমোঙ্কার ঋক্ সাম যজুরেব চ।।১৭
অর্থঃ- (১৭) আমি এই জগতের পিতা, মাতা, বিধাতা, পিতামহ; যাহা কিছু জ্ঞেয় এবং পবিত্র বস্তু তাহা আমিই। আমি ব্রহ্মবাচক ওঙ্কার, আমি ঋক্, সাম ও যজুর্ব্বেদ স্বরূপ।
গতির্ভর্ত্তা প্রভুঃ সাক্ষী নিবাসঃ শরণং সুহৃৎ।
প্রভবঃ প্রলয়ঃ স্থানং নিধানং বীজমব্যয়ম্।।১৮
প্রভবঃ প্রলয়ঃ স্থানং নিধানং বীজমব্যয়ম্।।১৮
অর্থঃ- (১৮) আমি গতি, আমি ভর্ত্তা, আমি প্রভু, আমি শুভাশুভ দ্রষ্টা, আমি স্থিতি, স্থান, আমি রক্ষক, আমি সুহৃৎ, আমি স্রষ্টা, আমি সংহর্ত্তা, আমি আধার, আমি লয়স্থান এবং আমিই অবিনাশী বীজস্বরূপ।
বিবিধ কর্ম্ম বা সধনায় যে গতি বা ফল পাওয়া যায় তাহা তিনিই। যে যাহা করুক তাহার শেষ গতি তিনিই। শুভাশুভ যে কোন কর্ম লোকে করে তিনি সবই দেখেন, এই জন্য তিনিই সাক্ষী। সর্ব্বভূত তাঁহাতেই বাস করে, তাই তিনি নিবাস। তিনি প্রভব, প্রলয় ও স্থান অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি, লয়কর্ত্তা। প্রলয়েও জীবসমূহ বীজ অবস্থায় তাহাতে অবস্থান করে, এই জন্য তিনি নিধান। প্রত্যুপকারের আশা না করিয়া সকলের উপকার করেন, তাই তিনি সুহৃৎ। তিনি আর্ত্তের আর্ত্তিহর, তাই তিনি শরণ।
তপাম্যহমহং বর্ষং নিগৃহ্নাম্যুৎসৃজামি চ।
অমৃতঞ্চৈব মৃত্যুশ্চ সদসচ্চাহমর্জ্জুন।।১৯
অমৃতঞ্চৈব মৃত্যুশ্চ সদসচ্চাহমর্জ্জুন।।১৯
অর্থঃ- (১৯) হে অর্জ্জুন, আমি (আদিত্যরূপে) উত্তাপ দান করি, আমি ভূমি হইতে জল আকর্ষণ করি, আমি পুনর্ব্বার জল বর্ষণ করি; আমি জীবের জীবন, আমিই জীবের মৃত্যু; আমি সৎ (অবিনাশী অব্যক্ত আত্মা), আমিই অসৎ (নশ্বর ব্যক্ত জগৎ)।
ত্রৈবিদ্যা মাং সোমপাঃ পূতপাপা যজ্ঞৈরিষ্ট্বা স্বর্গতিং প্রার্থয়ন্তে।
তে পুন্যমাসাদ্য সুরেন্দ্রলোকমশ্নন্তি দিব্যান্ দিবি দেবভোগান্।।২০
তে পুন্যমাসাদ্য সুরেন্দ্রলোকমশ্নন্তি দিব্যান্ দিবি দেবভোগান্।।২০
অর্থঃ- (২০) ত্রিবেদোক্ত যজ্ঞাদিকর্ম্মপরায়ণ ব্যক্তিগণ যজ্ঞাদি দ্বারা আমার পূজা করিয়া যজ্ঞশেষে সোমরস পানে নিষ্পাপ হন এবং স্বর্গলাভ কামনা করেন, তাঁহারা পবিত্র স্বর্গলোক প্রাপ্ত হইয়া দিব্য দেবভোগসমূহ ভোগ করিয়া থাকেন।
তে তং ভূক্ত্বা স্বর্গলোকং বিশালং ক্ষীণে পুণ্যে মর্ত্ত্যলোকং বিশন্তি।
এবং ত্রয়ীধর্ম্মমনুপ্রপন্না গতাগতং কামকামা লভন্তে।।২১
এবং ত্রয়ীধর্ম্মমনুপ্রপন্না গতাগতং কামকামা লভন্তে।।২১
অর্থঃ- (২১) তাঁহারা তাঁহাদের প্রার্থিত বিপুল স্বর্গসুখ উপভোগ করিয়া পুণ্যক্ষয় হইলে পুনরায় মর্ত্ত্যলোকে প্রবেশ করেন। এইরূপে কামনাভোগ-পরবশ এই ব্যক্তিগণ যাগযজ্ঞাদি বেদোক্ত ধর্ম্ম অনুষ্ঠান করিয়া পুনঃ পুনঃ সংসারে যাতায়াত করিয়া থাকেন।
বেদোক্ত যাগযজ্ঞাদির অনুষ্ঠানকারী সকাম ব্যক্তিগণ পুণ্যফল-স্বরূপ স্বর্গলোক প্রাপ্ত হন বটে, কিন্তু মোক্ষ প্রাপ্ত হন না। একথা পূর্ব্বে আরও কয়েক বার বলা হইয়াছে (২।৪২-৪৫, ৮।১৬।২৫ ইত্যাদি)। ২০-২৫ এই কয়েকটা শ্লোকে ফলাশায় দেবোপাসনা ও নিষ্কাম ঈশ্বরোপাসনায় পার্থক্য দেখান হইতেছে।
অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্য্যুপাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্।।২২
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্।।২২
অর্থঃ- (২২) অনন্যচিত্ত হইয়া আমার চিন্তা করিতে করিতে যে ভক্তগণ আমার উপাসনা করেন, আমাতে নিত্যুযুক্ত সেই সমস্ত ভক্তের যোগ ও ক্ষেম আমি বহন করিয়া থাকি (অর্থাৎ তাহাদের প্রয়োজনীয় আলব্ধ বস্তুর সংস্থান এবং লন্ধ বস্তুর রক্ষণ আমি করিয়া থাকি)।
যেহপ্যন্যদেবতাভক্তা যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ।
তেহপি মামেব কৌন্তেয় যজন্ত্যবিধিপূর্ব্বকম্।।২৩
তেহপি মামেব কৌন্তেয় যজন্ত্যবিধিপূর্ব্বকম্।।২৩
অর্থঃ- (২৩) হে কৌন্তেয়, যাহারা অন্য দেবতায় ভক্তিমান্ হইয়া শ্রদ্ধাযুক্তচিত্তে তাঁহাদের পূজা করে তাহারাও আমাকেই পূজা করে, কিন্তু অবিধিপূর্ব্বক (অর্থাৎ যাহাতে সংসার নিবর্ত্তক মোক্ষ বা ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটে তাহা না করিয়া)।
অহং হি সর্ব্বযজ্ঞানাং ভোক্তাচ প্রভুরেব চ।
ন তু মামভিজানন্তি তত্ত্বেনাহতশ্চ্যবন্তি তে।।২৪
ন তু মামভিজানন্তি তত্ত্বেনাহতশ্চ্যবন্তি তে।।২৪
অর্থঃ- (২৪) আমিই সর্ব্ব যজ্ঞের ভোক্তা ও ফলদাতা। কিন্তু তাহারা আমাকে যথার্থরূপে জানে না বলিয়া সংসারে পতিত হয়।
অন্য দেবতার পূজাও তোমারই পূজা। তবে তাহাদিগের পূজা করিলে সদ্গতিলাভ হইবে না কেন? কারণ, অন্যদেবতা-ভক্তেরা আমার প্রকৃত স্বরূপ জানে না; তাহারা মনে করে সেই সেই দেবতাই ঈশ্বর। এই অজ্ঞানতাবশতঃই তাহাদের সদ্গতি হয় না। তাহারা সংসারে পতিত হয়। কেননা, অন্য দেবতারা মোক্ষ দিতে পারেন না।
যান্তি দেবব্রতা দেবান্ পিতৄন্ যান্তি পিতৃব্রতাঃ।
ভূতানি যান্তি ভুতেজ্যা যান্তি মদ্ যাজিনোহপি মান্।।২৫
ভূতানি যান্তি ভুতেজ্যা যান্তি মদ্ যাজিনোহপি মান্।।২৫
অর্থঃ- (২৪) ইন্দ্রাদি দেবগণের পূজকেরা দেবলোক প্রাপ্ত হন, শ্রাদ্ধাদি দ্বারা যাঁহারা পিতৃগণের পূজা করেন তাঁহারা পিতৃলোক প্রাপ্ত হন, যাঁহারা যক্ষ-রক্ষাদি ভূতগণের পূজা করেন তাঁহারা ভূতলোক প্রাপ্ত হন, এবং যাঁহারা আমাকে পূজা করেন তাঁহারা আমাকেই প্রাপ্ত হন।
পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি।
তদহং ভক্ত্যুপহৃত্মশ্নামি প্রযতাত্মনঃ।।২৬
তদহং ভক্ত্যুপহৃত্মশ্নামি প্রযতাত্মনঃ।।২৬
অর্থঃ- (২৬) যিনি আমাকে পত্র, পুস্প, ফল, জল, যাহা কিছু ভক্তিপূর্ব্বক দান করেন, আমি সেই শুদ্ধচিত্ত ভক্তের ভক্তিপূর্ব্বক প্রদত্ত উপহার গ্রহণ করিয়া থাকি।
আমার পূজা অনায়াস-সাধ্য। ইহাতে বহুব্যয়সাধ্য উপকরণের প্রয়োজন নাই। ভক্তিসহ যাহা কিছু আমার ভক্ত আমাকে দান করেন, দরিদ্র ব্রাহ্মণ শ্রীদামের চিপিটকের ন্যায় তাহাই আমি আগ্রহের সহিত গ্রহণ করি। আমি দ্রব্যের কাঙ্গাল নহি, ভক্তির কাঙ্গাল। এই কথাটা বুঝাইবার জন্য ‘ভক্তিপূর্ব্বক’ শব্দটা দুইবার ব্যবহৃত হইয়াছে।
যৎ করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ।
যৎ তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ব মদর্পণম্।।২৭
যৎ তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ব মদর্পণম্।।২৭
অর্থঃ- (২৭) হে কৌন্তেয়, তুমি যাহা কিছু কর, যাহা কিছু ভোজন কর, যাহা কিছু হোম কর, যাহা কিছু দান কর, যাহা কিছু তপস্যা কর, তৎ সমস্তই আমাকে অর্পণ করিও।
শুভাশুভফলৈরেবং মোক্ষসে কর্ম্মবন্ধনৈঃ।
সন্ন্যাসযোগযুক্তাত্মা বিমুক্তো মামুপৈষ্যসি।।২৮
সন্ন্যাসযোগযুক্তাত্মা বিমুক্তো মামুপৈষ্যসি।।২৮
অর্থঃ- (২৮) এইরূপ সর্ব্ব কর্ম্ম আমাতে সমর্পণ করিলে শুভাশুভ কর্ম্ম-বন্ধন হইতে মুক্ত হইবে। আমাতে সর্ব্বকর্ম্ম সমর্পণরূপ যোগে যুক্ত হইয়া কর্ম্মবন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া আমাকেই প্রাপ্ত হইবে।
সমোহহং সর্ব্বভূতেষু ন মে দ্বেষ্যোহস্তি ন প্রিয়ঃ
যে ভজন্তি তু মাং ভক্ত্যা ময়ি তে তেষু চাপ্যহম্।।২৯
যে ভজন্তি তু মাং ভক্ত্যা ময়ি তে তেষু চাপ্যহম্।।২৯
অর্থঃ- (২৯) আমি সর্ব্বভূতের পক্ষেই সমান। আমার দ্বেষ নাই, প্রিয়ও নাই। কিন্তু যাহারা ভক্তিপূর্ব্বক আমার ভজনা করেন, তাঁহারা আমাতে অবস্থান করেন এবং আমিও সে সকল ভক্তেই অবস্থান করি।
অপি চেৎ সুদুরাচারো ভজতে মামনন্যভাক্।
সাধুরেব স মন্তব্যঃ সম্যগ্ ব্যবসিতো হি সঃ।।৩০
সাধুরেব স মন্তব্যঃ সম্যগ্ ব্যবসিতো হি সঃ।।৩০
অর্থঃ- (৩০) অতি দুরাচার ব্যক্তি যদি অনন্যচিত্ত (অনন্য ভজনশীল) হইয়া আমার ভজনা করে, তাহাকে সাধু বলিয়া মন করিবে। যেহেতু তাহার অধ্যবসায় উত্তম।
ক্ষিপ্রং ভবতি ধর্ম্মাত্মা শশ্বচ্ছান্তিং নিগচ্ছতি।
কৌন্তেয় প্রতিজানীহি ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি।।৩১
কৌন্তেয় প্রতিজানীহি ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি।।৩১
অর্থঃ- (৩১) ঈদৃশ দুরাচার ব্যক্তি শীঘ্র ধর্ম্মাত্মা হয় এবং নিত্য শান্তি লাভ করে; হে কৌন্তেয়, তুমি সর্ব্বসমক্ষে নিশ্চিত প্রতিজ্ঞা করিয়া বলিতে পার যে, আমার ভক্ত কখনই বিনষ্ট হয় না।
মাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য যেহপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ।
স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেহপি যান্তি পরাং গতিম্।।৩২
স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেহপি যান্তি পরাং গতিম্।।৩২
অর্থঃ- (৩২) হে পার্থ, স্ত্রীলোক, বৈশ্য ও শূদ্র, অথবা যাহারা পাপযোনিসম্ভূত অন্ত্যজ জাতি তাহারাও আমার আশ্রয় লইলে নিশ্চয়ই পরমগতি প্রাপ্ত হন।
শাস্ত্রজ্ঞানশূন্য স্ত্রী-শূদ্রাদির পক্ষে জ্ঞানযোগের সাহায্যে মুক্তি লাভ সম্ভবপর নহে। কিন্তু ভক্তিযোগ জাতিবর্ণনির্ব্বিশেষে সকলের পক্ষেই সুখসাধ্য; ভাগবত ধর্ম্মের ইহাই বিশেষত্ব। ইহাতে জাতিভেদ-জনিত অধিকারভেদ নাই।
কিং পুনর্ব্রাহ্মণাঃ পুণ্যা ভক্তা রাজর্ষয়স্তথা।
অনিত্যমসুখং লোকমিমং প্রাপ্য ভজস্ব মাম্।।৩৩
অনিত্যমসুখং লোকমিমং প্রাপ্য ভজস্ব মাম্।।৩৩
অর্থঃ- (৩৩) পুণ্যশীল ব্রাহ্মণ ও রাজর্ষিগণ যে পরম গতি লাভ করিবেন তাহাতে আর কথা কি আছে? অতএব তুমি (এই রাজর্ষি-দেহ লাভ করিয়া) আমার আরাধনা কর। কারণ এই মর্ত্ত্যলোক অনিত্য এবং সুখশূন্য।
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্ যাজী মাং নমস্কুরু।
মামেবৈষ্যসি যুক্ত্বৈবমাত্মানং মৎপরায়ণঃ।।৩৪
মামেবৈষ্যসি যুক্ত্বৈবমাত্মানং মৎপরায়ণঃ।।৩৪
অর্থঃ- (৩৪) তুমি সর্বদা মনকে আমার চিন্তায় নিযুক্ত কর, আমাতে ভক্তিমান্ হও, আমার পূজা কর, আমাকেই নমস্কার কর। এইরূপে মৎপরায়ণ হইয়া আমাতে মন সমাহিত করিতে পারিলে আমাকেই প্রাপ্ত হইবে।
ইতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসুপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুন-সংবাদে রাজবিদ্যা-রাজগুহ্য যোগো নাম নবমোহধ্যায়ঃ।
১) শিষ্য শ্রদ্ধাহীন এবং দোষদর্শী হইলে গুরু তাহাকে গুহ্য বিষয় উপদেশ দেন না । কিন্তু অর্জুন সেরূপ নহেন । তিনি গুহ্য বিষয় শ্রবণের অধিকারী, ‘অসূয়াশূন্য’ শব্দে তাহাই প্রকাশ পাইতেছে ।
২) রাজগুহ্য রাজবিদ্যা কি ?
বিদ্যামাত্রই সেকালে গুহ্য থাকিত । কেননা, অধিকারী শিষ্যগণ ব্যতীত অন্য কাহাকেও উহা উপদেশ করা হইত না । এই সকল গুহ্যবিদ্যার মধ্যে গীতোক্ত ভক্তিযোগই শ্রেষ্ঠ, তাই উহাকে রাজগুহ্য বলা হইয়াছে । ব্রহ্মবিদ্যা-সম্বন্ধে এই অধ্যায়ে এমন কিছু বলা হয় নাই, যাহা পূর্বে কথিত হয় নাই এবং যাহাকে গুহ্যতম বলা যাইতে পারে । ‘ইহা সুস্পষ্ট যে, অক্ষর অব্যক্ত ব্রহ্মের জ্ঞানকে লক্ষ্য করিয়া এই বর্ণনা করা হয় নাই । কিন্তু রাজবিদ্যা শব্দে এ-স্থলে ভক্তিমার্গই বিবক্ষিত হইয়াছে ।’ – [লোকমান্য তিলক]
বিদ্যামাত্রই সেকালে গুহ্য থাকিত । কেননা, অধিকারী শিষ্যগণ ব্যতীত অন্য কাহাকেও উহা উপদেশ করা হইত না । এই সকল গুহ্যবিদ্যার মধ্যে গীতোক্ত ভক্তিযোগই শ্রেষ্ঠ, তাই উহাকে রাজগুহ্য বলা হইয়াছে । ব্রহ্মবিদ্যা-সম্বন্ধে এই অধ্যায়ে এমন কিছু বলা হয় নাই, যাহা পূর্বে কথিত হয় নাই এবং যাহাকে গুহ্যতম বলা যাইতে পারে । ‘ইহা সুস্পষ্ট যে, অক্ষর অব্যক্ত ব্রহ্মের জ্ঞানকে লক্ষ্য করিয়া এই বর্ণনা করা হয় নাই । কিন্তু রাজবিদ্যা শব্দে এ-স্থলে ভক্তিমার্গই বিবক্ষিত হইয়াছে ।’ – [লোকমান্য তিলক]
১২) পাষণ্ডী = ভগবদ্বিমুখ অসুর লোক যেমন কংস, শিশুপাল ।
মোঘাশাঃ : শ্রীকৃষ্ণ অপেক্ষা অন্য দেবতারা শীঘ্র কামনা পূর্ণ করিবে, যাহারা এইরূপ নিষ্ফল আশা করে ।
মোঘকর্মাণঃ : ঈশ্বর-বিমুখ বলিয়া যাহাদের যাগযজ্ঞাদি কর্ম নিষ্ফল হয় ।
মোঘজ্ঞানাঃ : ভগবদ্ভক্তিহীন বলিয়া যাহাদের শাস্ত্রপাণ্ডিত্যাদি সমস্তই নিষ্ফল হয় ।
মোঘাশাঃ : শ্রীকৃষ্ণ অপেক্ষা অন্য দেবতারা শীঘ্র কামনা পূর্ণ করিবে, যাহারা এইরূপ নিষ্ফল আশা করে ।
মোঘকর্মাণঃ : ঈশ্বর-বিমুখ বলিয়া যাহাদের যাগযজ্ঞাদি কর্ম নিষ্ফল হয় ।
মোঘজ্ঞানাঃ : ভগবদ্ভক্তিহীন বলিয়া যাহাদের শাস্ত্রপাণ্ডিত্যাদি সমস্তই নিষ্ফল হয় ।
১৫) মত-পথ :
পরমেশ্বর বিশ্বতোমুখ, এই হেতুই তাঁহার উপাসনা-প্রণালীও বিভিন্ন হয় । জ্ঞান-যজ্ঞের অর্থ পরমেশ্বরের স্বরূপ-জ্ঞানের দ্বারাই বিচার করিয়া উহার দ্বারা সিদ্ধিলাভ করা । কিন্তু পরমেশ্বরের এই জ্ঞানও দ্বৈত-অদ্বৈত প্রভৃতি ভেদে অনেক প্রকারের হইতে পারে । এই কারণে জ্ঞান-যজ্ঞও বিভিন্ন প্রকারের হইতে পারে । ‘ ‘একত্ব’, ‘পৃথকত্ব’ প্রভৃতি পদের দ্বারা বুঝা যায় যে, অদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত প্রভৃতি সম্প্রদায় যদিও আধুনিক, তথাপি কল্পনাসকল প্রাচীন ।’ – [গীতারহস্য|লোকমান্য তিলক]
পরমেশ্বর বিশ্বতোমুখ, এই হেতুই তাঁহার উপাসনা-প্রণালীও বিভিন্ন হয় । জ্ঞান-যজ্ঞের অর্থ পরমেশ্বরের স্বরূপ-জ্ঞানের দ্বারাই বিচার করিয়া উহার দ্বারা সিদ্ধিলাভ করা । কিন্তু পরমেশ্বরের এই জ্ঞানও দ্বৈত-অদ্বৈত প্রভৃতি ভেদে অনেক প্রকারের হইতে পারে । এই কারণে জ্ঞান-যজ্ঞও বিভিন্ন প্রকারের হইতে পারে । ‘ ‘একত্ব’, ‘পৃথকত্ব’ প্রভৃতি পদের দ্বারা বুঝা যায় যে, অদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত প্রভৃতি সম্প্রদায় যদিও আধুনিক, তথাপি কল্পনাসকল প্রাচীন ।’ – [গীতারহস্য|লোকমান্য তিলক]
১৬) ক্রতু, যজ্ঞ – এই দুইটি সদৃশার্থক হইলেও একার্থক নহে । ‘যজ্ঞ’ শব্দ ‘ক্রতু’ শব্দ অপেক্ষা অধিক ব্যাপক । শ্রৌত যজ্ঞকে ক্রতু বলে । এস্থলে দুইটি শব্দই ব্যবহৃত হইয়াছে বলিয়া ক্রতু অর্থে অগ্নিষ্টোমাদি শ্রৌত যজ্ঞ এবং যজ্ঞ অর্থে স্মার্ত যজ্ঞাদি বুঝিতে হবে ।
১৮) বিবিধ কর্ম বা সধনায় যে গতি বা ফল পাওয়া যায় তাহা তিনিই । যে যাহা করুক তাহার শেষ গতি তিনিই । শুভাশুভ যে কোন কর্ম লোকে করে তিনি সবই দেখেন, এই জন্য তিনিই সাক্ষী । সর্বভূত তাঁহাতেই বাস করে, তাই তিনি নিবাস । তিনি প্রভব, প্রলয় ও স্থান অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি, লয়কর্তা । প্রলয়েও জীবসমূহ বীজ অবস্থায় তাহাতে অবস্থান করে, এই জন্য তিনি নিধান । প্রত্যুপকারের আশা না করিয়া সকলের উপকার করেন, তাই তিনি সুহৃৎ । তিনি আর্তের আর্তিহর, তাই তিনি শরণ ।
১৯) সৎ ও অসৎ : এই শব্দদ্বয় গীতা এবং বেদান্তাদি-শাস্ত্রে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে ।
সৎ = অক্ষর অবিনাশী অব্যক্ত ব্রহ্মবস্তু; অসৎ = নশ্বর ব্যক্ত জগৎ ।
সৎ = অব্যক্ত প্রকৃতি; অসৎ = ব্যক্ত জগৎ ।
সৎ = অস্তি, আছে; অসৎ = নাস্তি, নাই । যে-বস্তুর সৃষ্টি হয় এবং যাহার নাশ হইয়া থাকে সেই বস্তুই সৎ বা অসৎ । যাহা সৃষ্টির পূর্বেও ছিল এবং পরেও থাকিবে, তৎসম্বন্ধে ‘আছে’ বা ‘নাই’ এরূপ কিছুই বলা যায় না । তাই ব্রহ্মতত্ত্বের বর্ণনায় কখনো ‘ন সৎ ন অসৎ’ বলা হয় । কেননা, সেই অতীন্দ্রিয় ব্রহ্মবস্তু সত-অসৎ, আলোক-অন্ধকার, জ্ঞান-অজ্ঞান ইত্যাদি পরস্পর সতত-সাপেক্ষ দ্বৈত-বুদ্ধির অতীত অর্থাৎ সম্পূর্ণ অজ্ঞেয় ।
প্রাচীন উপনিষদাদিতে অনেক স্থলে বিপরীতার্থে এই শব্দদ্বয় ব্যবহার করা হইয়াছে । অর্থাৎ ‘সৎ’ = দৃশ্য ব্যক্ত জগৎ; ‘তৎ’ বা ‘অসৎ’ = অব্যক্ত ব্রহ্মবস্তু ।
২১) বেদোক্ত যাগযজ্ঞাদির অনুষ্ঠানকারী সকাম ব্যক্তিগণ পুণ্যফল-স্বরূপ স্বর্গলোক প্রাপ্ত হন বটে, কিন্তু মোক্ষ প্রাপ্ত হন না । একথা পূর্বে আরও কয়েক বার বলা হইয়াছে (২|৪২-৪৫, ৮|১৬,২৫ ইত্যাদি) । ২০-২৫ এই কয়েকটা শ্লোকে ফলাশায় দেবোপাসনা ও নিষ্কাম ঈশ্বরোপাসনায় পার্থক্য দেখান হইতেছে ।
সৎ = অব্যক্ত প্রকৃতি; অসৎ = ব্যক্ত জগৎ ।
সৎ = অস্তি, আছে; অসৎ = নাস্তি, নাই । যে-বস্তুর সৃষ্টি হয় এবং যাহার নাশ হইয়া থাকে সেই বস্তুই সৎ বা অসৎ । যাহা সৃষ্টির পূর্বেও ছিল এবং পরেও থাকিবে, তৎসম্বন্ধে ‘আছে’ বা ‘নাই’ এরূপ কিছুই বলা যায় না । তাই ব্রহ্মতত্ত্বের বর্ণনায় কখনো ‘ন সৎ ন অসৎ’ বলা হয় । কেননা, সেই অতীন্দ্রিয় ব্রহ্মবস্তু সত-অসৎ, আলোক-অন্ধকার, জ্ঞান-অজ্ঞান ইত্যাদি পরস্পর সতত-সাপেক্ষ দ্বৈত-বুদ্ধির অতীত অর্থাৎ সম্পূর্ণ অজ্ঞেয় ।
প্রাচীন উপনিষদাদিতে অনেক স্থলে বিপরীতার্থে এই শব্দদ্বয় ব্যবহার করা হইয়াছে । অর্থাৎ ‘সৎ’ = দৃশ্য ব্যক্ত জগৎ; ‘তৎ’ বা ‘অসৎ’ = অব্যক্ত ব্রহ্মবস্তু ।
২১) বেদোক্ত যাগযজ্ঞাদির অনুষ্ঠানকারী সকাম ব্যক্তিগণ পুণ্যফল-স্বরূপ স্বর্গলোক প্রাপ্ত হন বটে, কিন্তু মোক্ষ প্রাপ্ত হন না । একথা পূর্বে আরও কয়েক বার বলা হইয়াছে (২|৪২-৪৫, ৮|১৬,২৫ ইত্যাদি) । ২০-২৫ এই কয়েকটা শ্লোকে ফলাশায় দেবোপাসনা ও নিষ্কাম ঈশ্বরোপাসনায় পার্থক্য দেখান হইতেছে ।
২২) যোগক্ষেম : ভক্তের ভগবান, ঈশ্বর-চিন্তা ও বিষয়-চিন্তা
ভগবানের কর্ম দ্বিবিধ – (i)গৌণী ভক্তিযোগ (স্মরণ, কীর্তন, পূজার্চনাদি), (ii)নির্গুণা বা পরা ভক্তি সহকারে গীতার নিষ্কাম কর্মযোগ (সর্বভূতে ঈশ্বর আছেন জানিয়া সর্বভূতের হিতসাধন) ।
ভগবানের কর্ম দ্বিবিধ – (i)গৌণী ভক্তিযোগ (স্মরণ, কীর্তন, পূজার্চনাদি), (ii)নির্গুণা বা পরা ভক্তি সহকারে গীতার নিষ্কাম কর্মযোগ (সর্বভূতে ঈশ্বর আছেন জানিয়া সর্বভূতের হিতসাধন) ।
কিন্তু দিবারাত্র ঈশ্বরচিন্তা করিব বা সর্বভূতের হিতসাধনে দেশের কাজে, দশের কাজে ব্যস্ত থাকিব, তবে সংসার-চিন্তা, দেহের চিন্তা করিব কখন ? দেহরক্ষা না হইলে ঈশ্বরচিন্তাও হয় না, দশের কাজও হয় না – ‘নিজে বাঁচিলে তবে ধর্ম’ [বিশ্বামিত্র]; ‘আত্মানং সততং রক্ষেৎ’ [মনু] । ইহার উত্তরে শ্রীভগবান বলিতেছেন, যাহারা নিত্যযুক্ত হইয়া সতত আমারই চিন্তায়, আমারই কর্মে মগ্ন থাকে, তাহাদের যোগক্ষেম আমিই বহন করি অর্থাৎ দেহাদি-রক্ষণের ভার আমিই গ্রহণ করি । অন্যের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থাও ঈশ্বর করেন; তবে তাহাদিগকে চেষ্টা করিতে হয়, নিত্যযুক্ত (পাটোয়ারী বুদ্ধি-সহকারে নহে) ভগবদ্ভক্তের চেষ্টা করিতে হয় না, এই পার্থক্য ।
২৪) অন্য দেবতার পূজাও তোমারই পূজা । তবে তাহাদিগের পূজা করিলে সদ্গতিলাভ হইবে না কেন ? কারণ, অন্যদেবতা-ভক্তেরা আমার প্রকৃত স্বরূপ জানে না; তাহারা মনে করে সেই সেই দেবতাই ঈশ্বর । এই অজ্ঞানতাবশতঃই তাহাদের সদ্গতি হয় না । তাহারা সংসারে পতিত হয় । কেননা, অন্য দেবতারা মোক্ষ দিতে পারেন না ।
একেশ্বরবাদ – বহুদেবোপাসনা – মূর্তিপূজা
হিন্দু বহুদেবোপাসক হইলেও বহু-ঈশ্বরবাদী নহেন, প্রতিমা-পূজক হইলেও পৌত্তলিক (Idolator) নহেন । বেদে কতিপয় দেবতার উল্লেখ আছে, কিন্তু সে সকলই এক, বহুত্ব কল্পনামাত্র (‘একং সন্তং বহুধা কল্পয়ন্তি’ ঋগ্বেদ ১০|১১৪|৫) । দেবতাদিগেরও পূর্বে সেই অব্যক্ত হইতে ব্যক্ত জগৎ উৎপন্ন হইয়াছে [ঋ|১০|৭২|২] ।
হিন্দু বহুদেবোপাসক হইলেও বহু-ঈশ্বরবাদী নহেন, প্রতিমা-পূজক হইলেও পৌত্তলিক (Idolator) নহেন । বেদে কতিপয় দেবতার উল্লেখ আছে, কিন্তু সে সকলই এক, বহুত্ব কল্পনামাত্র (‘একং সন্তং বহুধা কল্পয়ন্তি’ ঋগ্বেদ ১০|১১৪|৫) । দেবতাদিগেরও পূর্বে সেই অব্যক্ত হইতে ব্যক্ত জগৎ উৎপন্ন হইয়াছে [ঋ|১০|৭২|২] ।
সুতরাং দেবতাগণ ঈশ্বর নহেন, ঈশ্বরের শক্তিবিশেষের বিভিন্ন প্রকাশ বা বিভূতি । ভয়ে, বিস্ময়ে, ভক্তিতে বা স্বার্থবুদ্ধিতে শক্তিমানের পূজা, বীর-পূজা, সকলেই করে; দেবগণের পূজাও তদ্রূপ, উহাতে অন্যবিধ ইষ্টলাভ হইতে পারে, ঈশ্বরলাভ হয় না ।
হিন্দুরা যে দেবদেবীর মূর্তি পূজা করেন, তাহাকে প্রতিমা (holy image বা প্রতীক symbol) বলে, পুত্তলিকা (Idol) বলে না । নাম-রূপ ব্যতীত মনুষ্যমন সেই অনন্তশক্তিমৎ অব্যক্ত বস্তু ধারণা করিতে পারে না; তাই ঈশ্বরের শক্তি-বিশেষের সহিত সাদৃশ্য কল্পনা করিয়া চিন্তার অবলম্বন-স্বরূপ একটা প্রতীক (symbol) গ্রহণ করা হয় মাত্র । মূর্তির প্রাণ-প্রতিষ্ঠা, স্তব-স্তুতি, ধ্যান-প্রণাম ইত্যাদি মন্ত্রাদির প্রতি লক্ষ্য করিলে স্পষ্টই বুঝা যায়, সাধক প্রতীক-অবলম্বনে ঈশ্বরেরই পূজা করিতেছেন, পুতুল পূজা করিতেছেন না । এইজন্যই প্রতিমা-পূজক ও পৌত্তলিক এক কথা নহে । কিন্তু যাঁহারা প্রকৃতির অতীত হইয়া অতীন্দ্রিয় তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিয়াছেন, তাঁহাদিগের প্রতিমারও প্রয়োজন হয় না । বস্তুত তাঁহার প্রতিমা (তুলনা) নাই ।
২৬) আমার পূজা অনায়াস-সাধ্য । ইহাতে বহুব্যয়সাধ্য উপকরণের প্রয়োজন নাই । ভক্তিসহ যাহা কিছু আমার ভক্ত আমাকে দান করেন, দরিদ্র ব্রাহ্মণ শ্রীদামের চিপিটকের ন্যায় তাহাই আমি আগ্রহের সহিত গ্রহণ করি । আমি দ্রব্যের কাঙ্গাল নহি, ভক্তির কাঙ্গাল । এই কথাটা বুঝাইবার জন্য ‘ভক্তিপূর্বক’ শব্দটা দুইবার ব্যবহৃত হইয়াছে ।
সাকারোপাসনা :
‘ফল-পুষ্পাদি প্রদান করিতে হইলে তাহা যে প্রতিমায় অর্পণ করিতে হইবে এমন কথা নাই । ঈশ্বর সর্বত্র আছেন, যেখানে দিবে সেখানেই তিনি পাইবেন ।’ – [বঙ্কিমচন্দ্র]
‘ফল-পুষ্পাদি প্রদান করিতে হইলে তাহা যে প্রতিমায় অর্পণ করিতে হইবে এমন কথা নাই । ঈশ্বর সর্বত্র আছেন, যেখানে দিবে সেখানেই তিনি পাইবেন ।’ – [বঙ্কিমচন্দ্র]
মানববুদ্ধি নাম-রূপের অতীত কোনো অতীন্দ্রিয় বস্তুর ধারণা করিতে পারে না, সুতরাং যে-পর্যন্ত না সাধক প্রকৃতির অতীত হইয়া অতীন্দ্রিয় তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেন, সে-পর্যন্ত তাঁহাকে সাকারের মধ্য দিয়া, স্থূলের মধ্য দিয়াই সূক্ষ্মে যাইতে হইবে, অন্য গতি নাই ।
‘আপনারা মনকে স্থির করিবার অথবা কোনোরূপ চিন্তা করিবার চেষ্টা করিয়া দেখিবেন – আপনারা মনে-মনে মূর্তি গঠন না করিয়া থাকিতে পারিতেছেন না । দুই প্রকার ব্যক্তির মূর্তি-পূজার প্রয়োজন হয় না । এক নরপশু, যে ধর্মের কোনো ধার ধারে না, আর সিদ্ধপুরুষ – যিনি এই সকল সোপান-পরম্পরা অতিক্রম করিয়াছেন । আমরা যতদিন এই দুই অবস্থার মধ্যে অবস্থিত, ততদিন আমাদের ভিতরে-বাহিরে, কোনো-না-কোনো রূপ আদর্শ বা মূর্তির প্রয়োজন হইয়া থাকে ।’ – [স্বামী বিবেকানন্দ, ভক্তি-রহস্য]
২৯) নরসিংহ : পুত্রের (প্রহ্লাদের) প্রীতি ও পিতার (হিরণ্যকশিপুর) বিদ্বেষ মূর্তিমান নরসিংহ-রূপ ধারণ করিল । বিদ্বেষ-সিংহ অভক্তকে বিনাশ করিল, ভক্তবৎসল নরদেব ভক্তকে ক্রোড়ে লইলেন । এই ভক্ত-রক্ষক ও অভক্ত-নাশক রূপ ভক্তের প্রীতি- ও অভক্তের বিদ্বেষ-ভাবেরই প্রতিমূর্তি – উহা ভগবানের বৈষম্য-প্রসূত নহে ।
৩১) ভক্তি-স্পর্শমণি :
অতি পাপাসক্ত ব্যক্তিও যদি নিমেষমাত্র অচ্যুতের ধ্যান করেন, তবে তিনি তপস্বী বলিয়া পরিগণিত হন; তিনি যাঁহাদিগের মধ্যে উপবেশন করেন তাঁহারাও পবিত্র বলিয়া পরিগণিত হন ।
অতি পাপাসক্ত ব্যক্তিও যদি নিমেষমাত্র অচ্যুতের ধ্যান করেন, তবে তিনি তপস্বী বলিয়া পরিগণিত হন; তিনি যাঁহাদিগের মধ্যে উপবেশন করেন তাঁহারাও পবিত্র বলিয়া পরিগণিত হন ।
নিমেষমাত্রে অসাধু সাধু হইয়া উঠে, এ-কথা অত্যুক্তি নহে । অন্ধকার গৃহে দীপ জ্বালিলে নিমেষমাত্রেই গৃহ আলোকিত হয়, স্পর্শমণির সংস্পর্শে নিমেষমাত্রেই লৌহখণ্ড সুবর্ণ হয়, ভক্তিস্পর্শেও মানুষ নিমেষমাত্রেই পবিত্র হইয়া যায় । ভক্তির এই পতিতপাবনী শক্তি আছে । কৃষ্ণসেবা, সাধুসঙ্গ, গুরুকৃপায় উহা লাভ হয় । মহাপুরুষগণ এই শক্তি সঞ্চারিত করিতে পারেন ।
তাই দেখি, সেই দরিদ্র ব্রাহ্মণ ধনলোভে বৃন্দাবনে দৌড়িলেন, সনাতন গোশ্বামীর নিকট পার্থিব স্পর্শমণি পাইলেন; কিন্তু উহা লইয়া আর গৃহে ফিরিতে পারিলেন না । গোস্বামীর পাদমূলে লুণ্ঠিত হইয়া সেই অপার্থিব স্পর্শমণি যাচ্ঞা করিলেন –
‘যে ধনে হইয়া ধনী, মণিরে মান না মণি
তাহারই খানিক
মাগি আমি নত শিরে’ । এত বলি নদীনীরে
ফেলিল মাণিক !
‘যে ধনে হইয়া ধনী, মণিরে মান না মণি
তাহারই খানিক
মাগি আমি নত শিরে’ । এত বলি নদীনীরে
ফেলিল মাণিক !
প্রায়শ্চিত্ত : জীবের পাপের সীমা নাই । শাস্ত্রেও বিধি-নিষেধের অন্ত নাই । সুতরাং প্রায়শ্চিত্তেরও নানা বিধান । গ্রহ-বিপ্রকে স্বর্ণদান হইতে তুষানলে জীবনদান পর্যন্ত কৃচ্ছ্র, অতিকৃচ্ছ্র, মহাকৃচ্ছ্র ইত্যাদি-রূপ প্রায়শ্চিত্তের অসংখ্য বিধি-ব্যবস্থা । কৃচ্ছ্র-সাধনে চিত্ত-শুদ্ধি হয়, সন্দেহ নাই; কিন্তু আন্তরিক অনুশোচনা ও ভগবদ্ভক্তির সহিত সংযুক্ত না হইলে উহা প্রাণহীন অনুষ্ঠান মাত্রে পর্যবসিত হয় । বরং দেশ-কাল-পাত্র-ভেদে সুব্যবস্থিত না হইলে সামাজিক অত্যাচার বলিয়াই গণ্য হয় ।
৩২) পাপযোনয়ঃ : পাপযোনি-সম্ভূত, নীচকুলজাত (অন্ত্যজ) । এই শব্দটি স্ত্রী-শূদ্রাদির বিশেষণ নয় ।
শাস্ত্রজ্ঞানশূন্য স্ত্রী-শূদ্রাদির পক্ষে জ্ঞানযোগের সাহায্যে মুক্তি লাভ সম্ভবপর নহে । কিন্তু ভক্তিযোগ জাতিবর্ণনির্বিশেষে সকলের পক্ষেই সুখসাধ্য; ভাগবত ধর্মের ইহাই বিশেষত্ব । ইহাতে জাতিভেদ-জনিত অধিকারভেদ নাই ।
৩৪) ঐকান্তিক ধর্ম – ভগবৎ-শরণাগতি :
একান্ত ভাবে ভগবানের শরণ লইয়া নিত্যযুক্ত হইয়া তাঁহার ভজনা করা এবং স্বধর্মরূপে ভৃত্যবৎ তাঁহারই কর্ম সম্পাদন করা ।
একান্ত ভাবে ভগবানের শরণ লইয়া নিত্যযুক্ত হইয়া তাঁহার ভজনা করা এবং স্বধর্মরূপে ভৃত্যবৎ তাঁহারই কর্ম সম্পাদন করা ।