শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা: সপ্তম অধ্যায় – জ্ঞান-বিজ্ঞান-যোগ (গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)

Tags

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা: সপ্তম অধ্যায় – জ্ঞান-বিজ্ঞান-যোগ
(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)

Image result for bhagavad gita chapter 7
শ্রীভগবানুবাচ –
ময্যাসক্তমনাঃ পার্থ যোগং যুঞ্জন্ মদাশ্রয়ঃ।
অসংশয়ং মাং যথা জ্ঞাস্যসি তচ্ছৃণু।।১
অর্থঃ- (১) শ্রীভগবান্‌ বলিলেন – হে পার্থ, তুমি আমাতে আসক্তচিত্ত এবং একমাত্র আমার শরণাপন্ন হইয়া যোগযুক্ত হইলে যেরূপে আমার সর্ব্ববিভূতিসম্পন্ন সমগ্র স্বরূপ নিঃসংশয়ে জানিতে পারিবে তাহা শ্রবণ কর।
পূর্ব্ব আধ্যায়ের শেষে শ্রীভগবান্‌ বলিয়াছেন, যোগিগণের মধ্যে যিনি মদ্গতচিত্তে আমাকে ভজনা করেন, তিনিই যুক্ততম। কিন্তু এই আমি কে? তাঁহার সমগ্র স্বরূপ কি? কি ভাবে তাঁহাকে ভাবনা করিতে হয়, ভজন করিতে হয়, তাহা এ পর্য্যন্ত কিছুই বলেন নাই। এই অধ্যায় এবং পরবর্ত্তী অধ্যায়সমূহে সেই সকল গুঢ় রহস্য কথিত হইয়াছে।
জ্ঞানং তেহহং সবিজ্ঞানমিদং বক্ষ্যাম্যশেষতঃ।
যজ্ জ্ঞাত্মা নেহ ভূয়হন্যজ্ জ্ঞাতব্যমবশিষ্যতে।।২
অর্থঃ- (২) আমি তোমাকে বিজ্ঞানসহ মৎস্বরূপ-বিষয়ক জ্ঞান বিশেষরূপে বলিতেছি। উহা জানিলে শ্রেয়োমার্গে পুনরায় জানিবার আর কিছু অবশিষ্ট থাকিবে না।
মনুষ্যণাং সহস্রেষু কশ্চিদ্ যততি সিদ্ধয়ে।
যততামপি সিদ্ধানাং কশ্চিন্মাং বেত্তি তত্ত্বতঃ।।৩
অর্থঃ- (৩) সহস্র সহস্র মনুষ্যের মধ্যে হয়ত একজন মদ্বিষয়ক জ্ঞান লাভের জন্য যত্ন করে। আবার, যাঁহারা যত্ন করিয়া সিদ্ধি লাভ করিয়াছেন মনে করেন, তাঁহাদিগেরও সহস্রের মধ্যে হয়ত একজন আমার প্রকৃত স্বরূপ জানিতে পারেন। (অর্থাৎ যাঁহাদিগকে তত্ত্বজ্ঞানী বা আত্মজ্ঞানী বলে, তাঁহাদিগেরও সহস্র জনের মধ্যে হয়ত একজন আমার প্রকৃত স্বরূপ জানেন। উহা অতি গুহ্য বিষয়)।
ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খংমনোবুদ্ধিরেবচ।
অহংকার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা।।৪
অর্থঃ- (৪) ক্ষিতি, অপ্‌ (জল), তেজ, মরুৎ (বায়ু), ব্যোম (আকাশ), মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার, এইরূপে আমার প্রকৃতি অষ্টভাগে ভেদ প্রাপ্ত হইয়াছে।
অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্।
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্য্যতে জগৎ।।৫
অর্থঃ- (৫) এই পূর্ব্বোক্ত অষ্টবিধা প্রকৃতি আমার অপরা প্রকৃত। ইহা ভিন্ন জীবরূপ চেতনাত্মিকা আমার পরা প্রকৃত আছে জানিও; হে মহাবাহো, সেই পরা প্রকৃতদ্বারা জগৎ বিধৃত রহিয়াছে।
এতদ্ যোনীনি ভূতানি সর্বাণীত্যুপধারয়।
অহং কৃৎস্নস্য জগতঃ প্রভবঃ প্রলয়স্তথা।।৬
অর্থঃ- (৬) সমস্ত ভূত এই দুই প্রকৃত হইতে জাত, ইহা জানিও। সুতরাং আমিই নিখিল জগতের উৎপত্তি ও লয়ের কারণ। (সুতরাং আমি প্রকৃতপক্ষে জগতের কারণ)।
অচেতনা অপরা প্রকৃতি দেহাদিরূপে (ক্ষেত্র) পরিণাম প্রাপ্ত হয়, চেতনা পরা প্রকৃতি বা জীবচৈতন্য (ক্ষেত্রজ্ঞ) ভোক্তৃরূপে দেহে প্রবেশ করিয়া দেহাদি ধারণ করিয়া রাখে। এই দুই প্রকৃতি আমারই প্রকৃতি, আমা হইতেই উৎপন্ন বা আমারই বিভাব, সুতরাং আমিই প্রকৃতপক্ষে জগতের কারণ।
মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয়।
ময়ি সর্ব্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব।।৭
অর্থঃ- (৭) হে ধনঞ্জয়, আমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পরমার্থ-তত্ত্ব অন্য কিছুই নাই; সূত্রে মণি-সমূহের ন্যায় সর্ব্বভূতের অধিষ্ঠানস্বরূপ আমাতে এই সমস্ত জগৎ রহিয়াছে।
রসোহহমপ্স কৌন্তেয় প্রভাহস্মি শশিসূর্য্যয়োঃ।
প্রণবঃ সর্ব্ববেদেষু শব্দঃ খে পৌরুষং নৃষু।।৮
অর্থঃ- (৮) হে কৌন্তেয়, জলে আমি রস, শশিসূর্য্যে আমি প্রভা, সর্ব্ববেদে আমি ওঙ্কার, আকাশে আমি শব্দ, মনুষ্য মধ্যে আমি পৌরুষরূপে বিদ্যমান আছি।
সকল পদার্থেরই যাহা সার, যাহা প্রাণ, তাহাতেই আমি অধিষ্ঠান করি। আমা ব্যতীত জল রসহীন, শশিসূর্য্য প্রভাবহীন, আকাশ শব্দহীন, পুরুষ পৌরুষহীন হয়; অর্থাৎ আমার সত্তায়ই সকলের সত্তা।
পুণ্যো গন্ধঃ পৃথিব্যাং চ তেজশ্চাস্মি বিভাবসৌ।
জীবনং সর্ব্বভূতেষু তপশ্চাস্মি তপস্বিষু।।৯
অর্থঃ- (৯) আমি পৃথিবীতে পবিত্র গন্ধ, অগ্নিতে তেজ, সর্ব্বভূতে জীবন এবং তপস্বীদগের তপঃস্বরূপ।
বীজং মাং সর্ব্বভূতানাং বিদ্ধি পার্থ সনাতনম্।
বুদ্ধির্বুদ্ধিমতামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম্।।১০
অর্থঃ- (১০) হে পার্থ, আমাকে সর্ব্বভূতের সনাতন বীজ বলিয়া জানিও। আমি বুদ্ধিমান্‌দিগের বুদ্ধি এবং তেজস্বিগণের তেজঃস্বরূপ।
বলং বলবতামস্মি কামরাগবিবর্জ্জিতম্।
ধর্মাবিরুদ্ধো ভূতেষু কামোহস্মি ভরতর্ষভ।।১১
অর্থঃ- (১১) হে ভরতর্ষভ, আমিই বলবান্‌দিগের কামরাগরহিত বল (অর্থাৎ স্বধর্মানুষ্ঠান সমর্থ সাত্ত্বিক বল) এবং প্রাণিগণের ধর্ম্মের অবিরোধী কাম (অর্থাৎ দেহ ধারণাদির উপযোগী শাস্ত্রানুমত বিষয়াভিলাষ)।
আমি বলবান্‌দগের বল, কিন্তু সে বল সাত্ত্বিক বল। তাহা বিষয়তৃষ্ণা রহিত। আবার আমিই প্রাণিগণের মধ্যে কামরূপে বিদ্যমান আছি। কিন্তু সেই কাম ধর্ম্মের অবিরোধী, অর্থাৎ শাস্ত্রানুমত গার্হস্থ্য-ধর্ম্মের অনুকূল দেহ-ধারণাদি বা স্ত্রী‑পুত্রাদিতে অভিলাষ।
যে চৈব সাত্ত্বিকা ভাবা রাজসাস্তামসাশ্চ যে।
মত্ত এবেতি তান্ বিদ্ধি ন ত্বহং তেষু তে ময়ি।।১২
অর্থঃ- (১২) শমদমাদি সাত্ত্বিক ভাব, হর্ষদর্পলোভাদি রাজসিক ভাব, শোকমোহাদি তামসিক ভাব, এই সকলই আমা হইতে জাত। কিন্তু আমি সে সকলে অবস্থিত নহি (অর্থাৎ জীবের ন্যায় সেই সকলের অধীন নহি), কিন্তু সে সকল আমাতে আছে (অর্থাৎ তাহারা আমার অধীন)।
ত্রিভির্গুণময়ৈর্ভাবৈরেভিঃ সর্ব্বমিদং জগৎ।
মোহিতং নাভিজানাতি মামেভ্যঃ পরমব্যয়ম্।।১৩
অর্থঃ- (১৩) এই ত্রিবিধ গুণময় ভাবের দ্বারা (সত্ত্বরজস্তমোগুণ দ্বারা) সমস্ত জগৎ মোহিত হইয়া রহিয়াছে, এ-সকলের অতীত অক্ষয় আনন্দস্বরূপ আমাকে স্বরূপতঃ জানিতে পারে না।
দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া।
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।।১৪
অর্থঃ- (১৪) এই ত্রিগুণাত্মিকা অলৌকিকী আমার মায়া নিতান্ত দুস্তরা। যাহারা একমাত্র আমারই শরণাগত হইয়া ভজনা করেন, তাহারাই কেবল এই সুদুস্তরা মায়া ঊত্তীর্ণ হইতে পারেন।
নং মাং দুস্কৃতিনো মূঢ়াঃ প্রপদ্যন্তে নরাধমাঃ।
মায়য়াহপহৃজ্ঞানা আসুরং ভাবমাশ্রিতাঃ।।১৫
অর্থঃ- (১৫) পাপকর্ম্মপরায়ণ, বিবেকশূন্য নরাধমগণ মায়াদ্বারা হতজ্ঞান হইয়া আসুর স্বভাব প্রাপ্ত হওয়ায় আমাকে ভজনা করে না।
চতুর্ব্বিধা ভজন্তে মাং জনাঃ সুকৃতিনোহর্জ্জুন।
আর্ত্তো জিজ্ঞাসুরর্থার্থী জ্ঞানী চ ভরতর্ষভ।।১৬
অর্থঃ- (১৬) হে ভরতর্ষভ, হে অর্জ্জুন, যে সকল সুকৃতিশালী ব্যক্তি আমাকে ভজনা করেন, তাহারা চতুর্ব্বিধ – আর্ত্ত, জিজ্ঞাসু, অর্থাথী এবং জ্ঞানী।
চতুর্ব্বিধ ভক্ত – পূর্ব্ব শ্লোকে যাহারা ভগবদ্‌বহির্ম্মূখ, পাষণ্ডী, তাহাদিগের কথা বলা হইয়াছে। এই শ্লোকে যে সুকৃতিশালী ব্যক্তিগণ ভগবানে ভক্তিমান্‌ তাঁহাদিগের কথা বলা হইল। ইহারা চতুর্ব্বিধ – (১) আর্ত্ত – রোগাদিতে ক্লিষ্ট অথবা অন্যরূপে বিপন্ন; যেমন – কুরুসভায় দ্রৌপদী। (২) জিজ্ঞাসু – অর্থাৎ আত্মজ্ঞান লাভেচ্ছু; যেমন মুকুন্দ, রাজর্ষি জনক ইত্যাদি। (৩) অর্থার্থী – ইহকালে বা পরলোকে ভোগ-সুখ লাভার্থ যাঁহারা ভজনা করেন; যেমন – সুগ্রীব, বিভীষণ, উপমন্যু, ধ্রুব ইত্যাদি। (৪) জ্ঞানী – তত্ত্বদর্শী, শ্রীভগবান্‌কে তত্ত্বতঃ যাঁহারা জানিয়াছেন- যেমন, প্রহ্লাদ, শুক, সনক ইত্যাদি। ইহাদিগের মধ্যে প্রথম তিন প্রকার ভক্ত সকাম। ব্রজগোপিকাদি নিস্কাম প্রেমিক ভক্ত।
তেষাং জ্ঞানী নিত্যযুক্ত একভক্তির্বিশিষ্যতে।
প্রিয়ো হি জ্ঞানিনোহত্যর্থমহং স চ মম প্রিয়ঃ।।১৭
অর্থঃ- (১৭) ইহাদিগের মধ্যে জ্ঞানী ভক্তই শ্রেষ্ঠ। তিনি সতত আমাতেই যুক্তচিত্ত এবং একমাত্র আমাতেই ভক্তিমান্‌। আমি জ্ঞানীর অত্যন্ত প্রিয় এবং তিনিও আমার অত্যন্ত প্রিয়।
উদারাঃ সর্ব্ব এবৈতে জ্ঞানী তাত্মৈব মে মতম্।
আস্থিতঃ স হি যুক্তাত্মা মামেবানুত্তমাং গতিম্।।১৮
অর্থঃ- (১৮) ইহারা সকলেই মহান্‌। কিন্তু জ্ঞানী আমার আত্মস্বরূপ, ইহাই আমার মত; যেহেতু মদেকচিত্ত সেই জ্ঞানী সর্ব্বোৎকৃষ্ট গতি যে আমি সেই আমাকেই আশ্রয় করিয়া থাকেন।
সকাম ভক্তগণকাম্য বস্তুর লাভার্থেই আমার ভজনা করিয়া থাকেন। কাম্য বস্তুও তাঁহাদের প্রিয়, আমিও তাঁহাদের প্রিয়। কিন্তু মদ্ব্যতিরিক্ত জ্ঞানীর অন্য কাম্যবস্তু নাই। আমিই তাঁহার একমাত্র গতি, সুহৃদ ও আশ্রয়। আমি তাঁহার আত্মস্বরূপ। সুতরাং তিনিও আমার আত্মস্বরূপ, কেননা, যে ভক্ত আমাকে যেরূপ প্রীতি করে আমিও তাহাকে সেইরূপ প্রীতি করিয়া থাকি।
বহুনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্মাং প্রপদ্যতে।
বাসুদেবঃ সর্ব্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্লভঃ।।১৯
অর্থঃ- (১৯) জ্ঞানী ভক্ত অনেক জন্মের পর “বাসুদেবই সমস্ত” এইরূপ জ্ঞান লাভ করিয়া আমাকে প্রাপ্ত হন; এইরূপ মহাত্মা অতি দুর্লভ।
কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেহন্যদেবতাঃ।
তং তং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া।।২০
অর্থঃ- (২০) (স্ত্রীপুত্র ধনমানাদি বিবিধ) কামনাদ্বারা যাহাদের বিবেক অপহৃত হইয়াছে, তাহারা নিজ নিজ কামনা-কলুষিত স্বভাবের বশীভূত হইয়া ক্ষুদ্র দেবতাদের আরাধনায় ব্রতোপবাসাদি যে সকল নিয়ম আছে তাহা পালন করিয়া অন্য দেবতার ভজনা করিয়া থাকে। (আমার ভজনা করে না)।
যো যো যাং যাং তনুং ভক্তঃ শ্রদ্ধয়ার্চ্চিতুমিচ্ছতি।
তস্য তস্যাচলাং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধাম্যহম্।।২১
অর্থঃ- (২১) যে যে সকাম ব্যক্তি ভক্তিযুক্ত হইয়া শ্রদ্ধাসহকারে যে যে দেবমূর্ত্তি অর্চ্চনা করিতে ইচ্ছা করে, আমি (অন্তর্য্যামিরূপে) সেই সকল ভক্তের সেই সেই দেবমূর্ত্তিতে ভক্তি অচলা করিয়া দেই।
স তয়া শ্রদ্ধয়া যুক্তস্তস্যারাধনমীহতে।
লভতে চ ততঃ কামান্ ময়ৈব বিহিতান্ হি তান্।।২২
অর্থঃ- (২২) সেই দেবোপাসক মৎবিহিত শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া সেই দেবমূর্ত্তির অর্চ্চনা করিয়া থাকে এবং সেই দেবতার নিকট হইতে নিজ কাম্যবস্তু লাভ করিয়া থাকে, সেই সকল আমাকর্ত্তৃকই বিহিত (কেননা সেই সকল দেবতা আমারই অঙ্গস্বরূপ)।
অন্তবত্তু ফলং তেষাং তদ্ভবত্যল্পমেধসাম্।
দেবান্ দেবযজো যান্তি মদ্ভক্তা যান্তি মামপি।।২৩
অর্থঃ- (২৩) কিন্তু অল্পবুদ্ধি সেই দেবোপাসকগণের আরাধনালব্ধ ফল বিনাশশীল দেবোপাসকগণ দেবলোক প্রাপ্ত হন, আর আমার ভক্তগণ আমাকেই লাভ করিয়া থাকেন।
অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ।
পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্।।২৪
অর্থঃ- (২৪) অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিগণ আমার নিত্য সর্ব্বোৎকৃষ্ট পরম স্বরূপ জানায় অব্যক্ত আমাকে প্রাকৃত ব্যক্তিভাবাপন্ন মনে করে।
নাহং প্রকাশঃ সর্ব্বস্য যোগমায়াসমাবৃতঃ।
মূঢ়োহয়ং নাভিজানাতি লোকো মামজমব্যয়ম্।।২৫
অর্থঃ- (২৫) আমি যোগমায়ায় সমাচ্ছন্ন থাকায় সকলের নিকট প্রকাশিত হই না। অতএব মূঢ় এই সকল লোক জন্মমরণরহিত আমাকে পরমেশ্বর বলিয়া জানিতে পারে না।
বেদাহং সমতীতানি বর্ত্তমানানি চার্জ্জুন।
ভবিষ্যাণি চ ভূতানি মান্তু বেদ ন কশ্চন।।২৬
অর্থঃ- (২৬) হে অর্জ্জুন, আমি ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্ত্তমান সমস্ত পদার্থকে জানি; কিন্তু আমাকে কেহই জানে না।
আমি সর্ব্বজ্ঞ, কেননা আমি মায়ার অধীন নহি, আমি মায়াধীশ। কিন্তু জীব মায়াধীন, সুতরাং অজ্ঞ। কেবল আমার অনুগৃহীত ভক্তগণই আমার মায়া ঊত্তীর্ণ হইয়া আমাকে জানিতে পারে।
ইচ্ছাদ্বেষসমুত্থেন দ্বন্দ্বমোহেন ভারত।
সর্ব্বভূতানি সম্মোহং সর্গে যান্তি পরন্তপ।।২৭
অর্থঃ- (২৭) হে ভারত, হে পরন্তপ, সৃষ্টিকালে অর্থাৎ স্থূলদেহ উৎপন্ন হইলেই প্রাণিগণ রাগদ্বেষজনিত সুখ-দুঃখাদি দ্বন্দ্ব কর্তৃক মোহ প্রাপ্ত হইয়া হতজ্ঞান হয় (সুতরাং আমাকে জানিতে পারে না)।
যেষাং ত্বন্তগতং পাপং জনানাং পুণ্যকর্ম্মণাম্।
তে দ্বন্দ্বমোহনির্ম্মুক্তা ভজন্তে মাং দৃঢ়ব্রতাঃ।।২৮
অর্থঃ- (২৮) কিন্তু পুণ্যকর্ম্ম দ্বারা যাহাদের পাপ বিনষ্ট হইয়াছে, সেই সকল দ্বন্দ্বমোহনির্ম্মুক্ত ধীরব্রত ব্যক্তি আমাকে ভজনা করিয়া থাকেন।
জরামরণমোক্ষায় মামাশ্রিত্য যতন্তি যে।
তে ব্রহ্ম তদ্ বিদুঃ কৃৎস্নমধ্যাত্মং কর্ম্ম চাখিলম্।।২৯
অর্থঃ- (২৯) যাহারা আমাতে চিত্ত সমাহিত করিয়া জরামরণ হইতে মুক্তি লাভের জন্য যত্ন করেন, তাহারা সেই সনাতন ব্রহ্ম, সমগ্র অধ্যাত্মবিষয় এবং সমস্ত কর্ম্মতত্ত্ব অবগত হন।
সাধিভূতাধিদৈবং মাং সাধিযজ্ঞঞ্চ যে বিদুঃ।
প্রয়াণকালেহপি চ মাং তে বিদুর্যুক্তচেতসঃ।।৩০
অর্থঃ- (৩০) যাহারা অধিভূত, অধিদৈব এবং অধিযজ্ঞের সহিত আমাকে (অর্থাৎ আমার এই সকল বিভিন্ন বিভাবসহ সমগ্র আমাকে) জানেন, সেই সকল ব্যক্তি আমাতে আসক্তচিত্ত হওয়ায় মৃত্যুকালে আমাকে জানিতে পারেন। মরণকালে মূর্চ্ছিত হইয়াও আমাকে বিস্মৃত হন না। (সুতরাং মদ্ভক্তগণের মুক্তিলাভের কোন বিঘ্ন নাই)।
ইতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসংবাদে জ্ঞান-বিজ্ঞান-যোগো নাম সপ্তমোহধ্যায়ঃ।

১) পূর্ব অধ্যায়ের শেষে শ্রীভগবান্‌ বলিয়াছেন, যোগিগণের মধ্যে যিনি মদ্গতচিত্তে আমাকে ভজনা করেন, তিনিই যুক্ততম । কিন্তু এই আমি কে ? তাঁহার সমগ্র স্বরূপ কি ? কি ভাবে তাঁহাকে ভাবনা করিতে হয়, ভজন করিতে হয়, তাহা এ পর্যন্ত কিছুই বলেন নাই । এই অধ্যায় এবং পরবর্তী অধ্যায়সমূহে সেই সকল গুঢ় রহস্য কথিত হইয়াছে ।
২) জ্ঞান ও বিজ্ঞান : ‘এই নশ্বর সৃষ্টি-প্রপঞ্চের মধ্যে যে অবিনশ্বর পরতত্ত্ব অন্তর্নবিষ্ট রহিয়াছেন তাহা জানিবার নাম জ্ঞান, আর সেই একই নিত্য পরম তত্ত্ব হইতে এই বিবিধ নশ্বর পদার্থের উৎপত্তি কিরূপে হয়, তাহা বুঝিবার নাম বিজ্ঞান ।’ [লোকমান্য তিলক]
৩) যাঁহাদিগকে তত্ত্বজ্ঞানী বা আত্মজ্ঞানী বলে, তাঁহাদিগেরও সহস্র জনের মধ্যে হয়ত একজন আমার প্রকৃত স্বরূপ জানেন । উহা অতি গুহ্য বিষয় ।
৪-৭) গীতার সৃষ্টিতত্ত্ব এবং সাংখ্যের ২৫ তত্ত্ব
৬) অচেতনা অপরা প্রকৃতি দেহাদিরূপে (ক্ষেত্র) পরিণাম প্রাপ্ত হয়, চেতনা পরা প্রকৃতি বা জীবচৈতন্য (ক্ষেত্রজ্ঞ) ভোক্তৃরূপে দেহে প্রবেশ করিয়া দেহাদি ধারণ করিয়া রাখে । এই দুই প্রকৃতি আমারই প্রকৃতি, আমা হইতেই উৎপন্ন বা আমারই বিভাব, সুতরাং আমিই প্রকৃতপক্ষে জগতের কারণ ।
৮) সকল পদার্থেরই যাহা সার, যাহা প্রাণ, তাহাতেই আমি অধিষ্ঠান করি । আমা ব্যতীত জল রসহীন, শশিসূর্য্য প্রভাবহীন, আকাশ শব্দহীন, পুরুষ পৌরুষহীন হয়; অর্থাৎ আমার সত্তায়ই সকলের সত্তা ।
পুরুষকার : ‘মনুষ্যে আমি পৌরুষ’
অদৃষ্টবাদী, আত্মশক্তিতে অবিশ্বাসী, পর-প্রত্যাশী লোকের পক্ষে এই কথাটি দ্রষ্টব্য । শ্রীভগবান বলিতেছেন – মনুষ্যের পৌরুষ আমিই । আমা-হইতেই মনুষ্যের কর্মোদ্যম, কর্মশক্তি, পুরুষকার । এ-কথার দুইটি গূঢ়ভাব আছে ।
প্রথমত, মনুষ্যের শক্তি ঈশ্বরেরই শক্তি, সুতরাং সেজন্য শক্তিমানের গৌরব করিবার কিছু নাই । এই ভাবটি গ্রহণ করিলে ‘আমিত্বের’ প্রসার লোপ পায় । উদাহরণ : মহাভারতে, কুরুক্ষেত্র-অন্তে শ্রীকৃষ্ণ যখন অন্তর্ধান করিলেন, তখন অর্জুন লগুড়ধারী কৃষকগণের হস্তে পরাস্ত হইলেন । শক্তি পার্থের নহে, পার্থ-সারথির; তাঁহার অভাবে পুরুষকারের প্রতিমূর্তি পার্থ পৌরুষহীন ।
দ্বিতীয়ত, আমার মধ্যে তাঁহারই শক্তি, তবে আমি শক্তিহীন কিসে ? এই ভাবটি গ্রহণ করিলে আত্মশক্তিতে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে । কর্মফল ও জন্মান্তর হিন্দুধর্মের মজ্জাগত, সুতরাং অদৃষ্টবাদ উহার অঙ্গাঙ্গীভূত । কিন্তু পূর্বজন্মের পুরুষকার বা কর্মের ফলই ইহ-জন্মের অদৃষ্ট, ইহজন্মে যাহা পুরুষকার তাহারই ফল হইবে পরজন্মে অদৃষ্ট । সুতরাং পুরুষকার ব্যতীত অদৃষ্টের খণ্ডন হয় না ।
‘পুরুষগর্দভের ন্যায় অনুদ্যোগী হইও না, শাস্ত্রানুযায়ী উদ্যোগ ইহলোক ও পরলোক উভয়লোকের উপকারী ।’ [বশিষ্ঠদেব]
‘উচ্চবংশে বা নীচবংশে জন্ম দৈবায়ত্ত । কিন্তু পৌরুষ আমার আয়ত্ত । দেখিবে তোমরা আমার পৌরুষ ।’ [সূতপুত্র কর্ণ, মহাভারত]
১১) আমি বলবান্‌দিগের বল, কিন্তু সে বল সাত্ত্বিক বল । তাহা বিষয়তৃষ্ণা রহিত । আবার আমিই প্রাণিগণের মধ্যে কামরূপে বিদ্যমান আছি । কিন্তু সেই কাম ধর্মের অবিরোধী, অর্থাৎ শাস্ত্রানুমত গার্হস্থ্য-ধর্মের অনুকূল দেহ-ধারণাদি বা স্ত্রী‑পুত্রাদিতে অভিলাষ ।
১২) প্রশ্ন ১ঃ ঈশ্বর মঙ্গলময়, আনন্দময়, তবে তাঁহার সৃষ্টিতে অমঙ্গল ও দুঃখ কেন ?
উত্তর ১ঃ জীবের শিক্ষার জন্য, সংশোধনের জন্য, সেই পরম পদলাভে যোগ্যতার পরীক্ষাস্বরূপে এই সকল বিহিত হইয়াছে, যেমন অগ্নি-দাহনে স্বর্ণের বিশুদ্ধতা সম্পন্ন হয় ।
উত্তর ২ঃ দুঃখভোগ জীবের ইহজন্ম বা পূর্বজন্মের কর্মফল, পাপের ফল – ন্যায়বান ঈশ্বরের উহা ন্যয্য ব্যবস্থা, উহাতে পক্ষপাতিত্ব বা স-মমত্ব প্রকাশ পায় না ।
প্রশ্ন ২ঃ কর্মফল যদি অকাট্য, অখণ্ডনীয় হয়, কর্ম যদি ঈশ্বর অপেক্ষাও বড় হয়, তবে জীব কাতরপ্রাণে ঈশ্বরকে ডাকে কেন ? পূর্বমীমাংসা মতানুসারে ও বৌদ্ধ মতানুসারে ঈশ্বর বাদ দিয়া আত্মসাধনা দ্বারা কর্মবীজ নাশের উপায় করাই কি শ্রেয়-পথ নহে ?
উত্তরঃ সে এক পথ আছে, কিন্তু শ্রেয়-পথ বলা যায় না, কেননা উহাতে রোগনাশের সঙ্গে-সঙ্গে রোগীরও শেষ হয় । সাংখ্যের কৈবল্য বা বৌদ্ধের নির্বাণে সব ফুরাইয়া যায়, উহাতে দুঃখের নাশ হয়, সুখের লেশ নাই । সংসারে দুঃখ কেন, পাপ কেন, মানবের অন্তরে এই যে ধর্মাধর্মের নিত্যবিবাদ, ইহার কারণ কি – সকল দেশের সকল ধর্মশাস্ত্রেই ইহার মীমাংসার চেষ্টা হইয়াছে ।
ধর্মাধর্মের নিত্যবিবাদ :
প্রাচীন জোরোয়াস্ট্রীয়ান ধর্মের আহুরমাজদা ও অহির্মাণের (অঙ্ঘমন্যু) সংগ্রাম, খৃষ্টিয়াদি ধর্মশাস্ত্রে বর্ণিত ঈশ্বর এবং শয়তান বা ইবলিসের সংগ্রাম, মানবাত্মাকে অধিকারের জন্য ধর্মাধর্মের নিত্য-দ্বন্দ্বই রূপকের ভাষায় প্রকাশ করিতেছে । কিন্তু পাপের প্রবর্তক বা অধিনায়ক-স্বরূপ ঈশ্বরের একজন প্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টি করিয়া এ-প্রশ্নের মীমাংসা হয় না, বরং ঈশ্বরত্বেরই হানি হয় । হিন্দুশাস্ত্রেও দেবাসুর সংগ্রামের মধ্য দিয়া ধর্ম ও অধর্মের কল্পনা করা যায় । তবে হিন্দুশাস্ত্রে স্পষ্টই উল্লিখিত আছে যে, দেবগণ (ধর্মশক্তি) ও অসুরগণ (অধর্মশক্তি), উভয়ই সেই পরম-পুরুষ হইতেই জাত [ভাগবত |৮|৫|২১] । সেই পরম-পুরুষের স্তন হইতে ধর্ম এবং পৃষ্ঠদেশ হইতে অধর্ম [ভাগবত |৮|৫|৪০] । বস্তুত শুভ-অশুভ, জ্ঞান-অজ্ঞান, ধর্মাধর্ম, পাপপুণ্য, প্রীতি-হিংসা, সকলই তাঁহা-হইতে – কিন্তু তিনি এ-সকল দ্বন্দ্বের অতীত ।
দুঃখবাদ/সন্ন্যাসবাদ : সংসার ত্রিতাপের (ত্রিবিধ দুঃখের) আগার, কারাগার । ত্রিতাপ – (i)আধিভৌতিক (সর্পব্যাঘ্রাদি-হিংস্রজন্তু হইতে দুঃখ), (ii)আধ্যাত্মিক (আধি-ব্যাধি-জনিত দুঃখ), (iii)আধিদৈবিক (দৈবদুর্যোগ, গ্রহবৈগুণ্যাদি-জনিত দুঃখ)
লীলাবাদ/সুখবাদ : ‘লীলা’ শব্দের অর্থ খেলা । আনন্দ-লীলা = সৃষ্টির আনন্দ, বহু হইবার আনন্দ, আবার সেই বহু হইতে আপনাকে লুকাইয়া রাখিয়া লুকোচুরি খেলার আনন্দ । তিনি তো দেখা দিবার জন্যই ব্যকুল, তিনি কেবল চান, জীব তাঁহাকে অন্বেষণ করিয়া বাহির করুক, নচেৎ খেলা হয় না ।
‘এ সংসার মজার কুটি, আমি খাই দাই আর মজা লুটি ।’ – [আজু গোঁসাই]; ‘জগতে আনন্দ-যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ, ধন্য হলো ধন্য হলো, মানব-জীবন ।’ – [রবীন্দ্রনাথ]
জীব যে দুঃখ ভোগ করে সে দুঃখ তিনিও ভোগ করেন, কেননা জীবের মধ্যে তো তিনিই আছেন – ‘মহামায়ার ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ি কাঁদে’ । জীব ব্রহ্মকণা – ব্রহ্মের অংশ । ব্রহ্মই জীবরূপে প্রকৃতির ত্রিগুণের বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া সুখদুঃখ ভোগ করেন ।
স্বামী বিবেকানন্দকে আমেরিকায় কোনো সভায় এই প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল – ‘সংসারে দুঃখ কেন ?’ তিনি বলিলেন – ‘দুঃখ আছে আগে প্রমাণ করুন, পরে উত্তর দিব ।’ তিনি সেই আনন্দের সন্ধান পাইয়াছিলেন, তাই বেদান্তের সেই অমৃত বাণী, আনন্দবার্তাই ঘোষণা করিয়াছিলেন । যাঁহারা সে আনন্দের কণামাত্র আস্বাদ করিয়াছেন, তাঁহারাই ইহার সাক্ষী যেমন প্রভু শ্রীবাস আচার্য গৃহাঙ্গনে মৃত পুত্র রাখিয়াও কীর্তনানন্দে মত্ত হইয়াছিলেন ।
জীবাত্মার ক্রমবিকাশ-তত্ত্ব :
১৩-১৪) মায়াতত্ত্ব : ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিকেই এখানে মায়া বলা হইয়াছে । বস্তুত সাংখ্যে যাহাকে প্রকৃতি বলে, উহাকে বেদান্তে মায়া, অবিদ্যা বা অজ্ঞান বলা হয় এবং উহাই শাস্ত্রান্তরে মহামায়া, আদ্যাশক্তি, দুর্গা, কালী নামে অভিহিত । এই বিভিন্ন শব্দগুলি এক বস্তু সম্বন্ধে প্রযুক্ত হইলেও সেই বস্তুতত্ত্বটি সকলে ঠিক একভাবে গ্রহণ করেন না । ব্রহ্মস্বরূপ সম্বন্ধে যেমন নানারূপ মতভেদ আছে এবং তদনুরূপ উপাস্য-উপাসনা-প্রণালীরও পার্থক্য হয়, সেইরূপ প্রকৃতি বা মায়ার স্বরূপ সম্বন্ধেও মতভেদ অবশ্যম্ভাবী । বস্তুত ইনি যেমন ‘দুস্তরা’, তেমনি দুর্বোধ্যা । বস্তুত নিরীশ্বর সাংখ্য ব্যতীত সকল শাস্ত্রই বলেন যে, প্রকৃতি বা মায়া ঈশ্বরেরই শক্তি । ‘ইহা সৎ নহে, অসৎ নহে, ইহা অনির্বচনীয়, ত্রিগুণাত্মক, জ্ঞানবিরোধী, ভাবরূপ কোনো-কিছু ।’ – [বেদান্তসার] । ইহার ত্রৈকালিক অস্তিত্ব নাই, জ্ঞান হইলে অজ্ঞান থাকে না । মায়া অনির্বাচ্য হইলেও উহা ব্রহ্মের শক্তি বলিয়াই বর্ণিত হয় । উহার শক্তি দ্বিবিধ :-
আবরণশক্তি – এর ফলে জীব আপনাকে ব্রহ্ম হইতে ভিন্ন মনে করে ।
বিক্ষেপশক্তি – আমি কর্তা, আমি ভোক্তা ইত্যাদি কল্পনা সৃষ্টি করিয়া সংসার-মোহে জড়িত হয় ।
বিবর্তবাদ/মায়াবাদ : অদ্বৈতবাদে ব্রহ্মের দ্বিবিধ লক্ষণ বর্ণিত হয় :-
স্বরূপ-লক্ষণ – ব্রহ্ম নির্বিকল্প, নির্গুণ, সমস্ত বিশেষ বর্জিত – অজ্ঞেয়, অমেয়, অচিন্ত্য ইত্যাদি ।
তটস্থ-লক্ষণ – ব্রহ্ম সগুণ, সবিশেষ – সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তি, সর্বকর্মা, সৃষ্টিস্থিতি-প্রলয়কর্তা ।
এই মতে সগুণ ব্রহ্মের পারিমার্থিক সত্তা নাই । ইহা ‘নির্গুণ ব্রহ্মের মায়া-উপহিত বিবর্ত, সঙ্কল্পমাত্র সিদ্ধ অবস্তু’ । ব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপ নির্বিশেষ, নির্গুণ । এই মতে ঈশ্বর, জীব, জগৎ – নির্গুণ ব্রহ্মবস্তুর মায়াজন্য বিবর্ত মাত্র, ইহাকেই বিবর্তবাদ বা মায়াবাদ বলে । এক বস্তু অন্যরূপে প্রতীয়মান হইলে তাহা বিবর্ত (যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রম) । অথবা ‘পোদ্দারের নিকট যেমন গোট, তাবিজ, বাজুবন্দ প্রভৃতি গহনা মিথ্যা, সেই সব গহনার সোনাই সত্য তেমনি নাম ও রূপের দ্বারা আচ্ছাদিত ও নামরূপের মূলে সতত সমানভাবে অবস্থিত অবিনাশী ও অপরিবর্তনীয় বস্তুতত্ত্বই সত্য ।’ – [গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক]
পরিণামবাদ : বিশিষ্টাদ্বৈতবাদিগণ ব্রহ্মের এই স্বরূপ-লক্ষণ ও তটস্থ-লক্ষণ স্বীকার করেন না । এই মতে সবিশেষ ব্রহ্মই প্রমাণসিদ্ধ । এই জগৎ ব্রহ্মেরই শরীর, ব্রহ্মই জগৎরূপে পরিণত হন । এক বস্তু অন্য প্রকারে পরিণত হইলে তাহা বিকার বা পরিণাম (যেমন দুধ হইতে দধি) । পুরুষ, প্রকৃতি, পরমেশ্বর – ব্রহ্মেরই এই তিন ভাব । ‘জগতের সত্য-মিথ্যা সম্বন্ধে গীতা প্রধানত বিশিষ্টাদ্বৈত-মতের অনুযায়ী পরিণামবাদেরই অনুমোদন করিয়াছেন । অদ্বৈতমতানুযায়ী বিবর্তবাদের সমাদর করেন নাই ।’ – [গীতার ঈশ্বরবাদ, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত]
ভক্তিশাস্ত্র ও অচিন্ত্য-ভেদাভেদবাদ :
কৃষ্ণই কর্তা, মায়া যন্ত্রস্বরূপ । ভগবান বা ঈশ্বর বলিতে নির্গুণ, নির্বিশেষ কিছু বুঝায় না, অনন্ত শক্তিবিশিষ্ট বস্তুতত্ত্বই ভগবান । তাঁহার শক্তির ত্রিবিধ প্রকাশ :-
অন্তরঙ্গা চিচ্ছক্তি = স্বরূপশক্তি । তিনি সচ্চিনানন্দস্বরূপ, সুতরাং তাঁহার স্বরূপশক্তি তিন অংশে ত্রিবিধ – ‘আনন্দাংশে হ্লাদিনী, সদংশে সন্ধিনী, চিদংশে সংবিৎ, যাঁরে জ্ঞান করি মানি ।’
তটস্থা জীবশক্তি = গীতার পরাপ্রকৃতি; জীবরূপে প্রকাশিত; উহা ভেদ ও অভেদরূপে প্রকাশ পায়, যেমন অগ্নি ও স্ফুলিঙ্গ । স্ফুলিঙ্গ অগ্নিকণা মাত্র । পূর্ণশক্তি ঈশ্বর ও অণুশক্তি জীবে এইরূপ ভেদাভেদ-সম্বন্ধ । ইহাই গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ‘অচিন্ত্য-ভেদাভেদবাদ’ ।
বহিরঙ্গা মায়াশক্তি = গীতার অপরাপ্রকৃতি; জগৎ-সৃষ্টিকর্ত্রী । কিন্তু ঈশ্বরের অধিষ্ঠান বা ইচ্ছা ব্যতীত প্রকৃতির সৃষ্টিসামর্থ্য নাই । সুতরাং সাংখ্যের জড়া প্রকৃতি ও মায়ার পার্থক্য আছে ।
তন্ত্রশাস্ত্রে শক্তি :
তন্ত্রশাস্ত্রে সাংখ্যের প্রকৃতি বা শক্তিরই প্রাধান্য, শক্তিই ঈশ্বরী । সাংখ্যের পুরুষই শিব – শয়ান, নিষ্ক্রিয়, উদাসীন, দ্রষ্টা, সাক্ষী ও অনুমন্তা; আর তাঁহার সম্মুখে বিশ্বলীলায় নৃত্যপরা ক্রীড়াশীলা প্রকৃতিই কালী । বেদান্তের ভাষায় – এই শক্তি পরব্রহ্মের স্পন্দনশক্তি । ‘চিন্ময় ব্রহ্মই শিব, আর তাঁহার মনোময়ী স্পন্দনশক্তিই কালী ।’ তাই শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য আনন্দলহরীতে ইঁহাকে ‘পরব্রহ্ম-মহিষী’ বলিয়াছেন । বস্তুত প্রপঞ্চাতীত অবস্থায় যিনি ‘শান্তং শিবম্‌ অদ্বৈতম্‌’, সৃষ্টিপ্রপঞ্চে তিনিই শিব-শক্তি । শক্তিমান ও শক্তি এক, কেবল তাহাই নহে, শক্তি ব্যতীত শক্তিমানের কার্যক্ষমতাই নাই – সুতরাং শক্তিই উপাস্যা ।
ব্রহ্মশক্তি = (i) জ্ঞানশক্তি / বৈষ্ণবী-শক্তি (সাত্ত্বিকী মায়া), (ii) ইচ্ছাশক্তি / ব্রাহ্মী-শক্তি (রাজসী মায়া), (iii) ক্রিয়াশক্তি / রৌদ্রী-শক্তি (তামসী মায়া) ।
এই ত্রিবিধ শক্তিদ্বারাই মহামায়া জগন্ময়ী জগতের সৃষ্টি-স্থিতী-সংহার কার্য করিতেছেন; তিনিই ত্রৈগুণ্যময়ী প্রকৃতি । সৃষ্টিতে শক্তির অনন্ত বিকাশ । সুতরাং আদ্যাশক্তিরও নানা মূর্তি, নানা বিভাব । ইনি ভোগে ভবানী, সমরে সিংহবাসিনী দশপ্রহরণধারিণী দুর্গা, জগৎ-রক্ষায় জগদ্ধাত্রী, প্রলয়ে আবার ইনিই করালী কালী ।
১৬) চতুর্বিধ ভক্ত : পূর্ব শ্লোকে যাহারা ভগবদ্বহির্মুখ, পাষণ্ডী, তাহাদিগের কথা বলা হইয়াছে । এই শ্লোকে যে সুকৃতিশালী ব্যক্তিগণ ভগবানে ভক্তিমান্‌ তাঁহাদিগের কথা বলা হইল । ইহারা চতুর্বিধ – (১) আর্ত – রোগাদিতে ক্লিষ্ট অথবা অন্যরূপে বিপন্ন, যেমন – কুরুসভায় দ্রৌপদী । (২) জিজ্ঞাসু – অর্থাৎ আত্মজ্ঞান লাভেচ্ছু, যেমন মুকুন্দ, রাজর্ষি জনক ইত্যাদি । (৩) অর্থার্থী – ইহকালে বা পরলোকে ভোগ-সুখ লাভার্থ যাঁহারা ভজনা করেন, যেমন – সুগ্রীব, বিভীষণ, উপমন্যু, ধ্রুব ইত্যাদি । (৪) জ্ঞানী – তত্ত্বদর্শী, শ্রীভগবান্‌কে তত্ত্বতঃ যাঁহারা জানিয়াছেন, যেমন, প্রহ্লাদ, শুক, সনক ইত্যাদি । ইহাদিগের মধ্যে প্রথম তিন প্রকার ভক্ত সকাম । ব্রজগোপিকাদি নিষ্কাম প্রেমিক ভক্ত ।
১৮) সকাম ভক্তগণকাম্য বস্তুর লাভার্থেই আমার ভজনা করিয়া থাকেন । কাম্য বস্তুও তাঁহাদের প্রিয়, আমিও তাঁহাদের প্রিয় । কিন্তু মদ্ব্যতিরিক্ত জ্ঞানীর অন্য কাম্যবস্তু নাই । আমিই তাঁহার একমাত্র গতি, সুহৃদ ও আশ্রয় । আমি তাঁহার আত্মস্বরূপ । সুতরাং তিনিও আমার আত্মস্বরূপ, কেননা, যে ভক্ত আমাকে যেরূপ প্রীতি করে আমিও তাহাকে সেইরূপ প্রীতি করিয়া থাকি ।
১৯) বাসুদেবঃ = যিনি সর্ববিশ্ব ব্যাপিয়া আছেন, এবং যিনি সর্বভূতে বাস করেন; পরমাত্মা, পরমেশ্বর, পুরুষোত্তম । বস্‌ ধাতু = আচ্ছাদন করা, বাস করা ।
২৪) অবতার ও অবতারী :
যিনি অব্যক্ত, নির্বিশেষ, নির্বিকার, লীলাবশে তিনিই ব্যক্তি হইয়া সবিশেষ সাকার রূপ ধারণ করেন, ইহাই অবতার । অব্যক্ত-স্বরূপে যিনি অবতারী, ব্যক্ত-স্বরূপে তিনিই অবতার । সুতরাং ঈশ্বর নির্গুণ হইয়াও সগুণ, নিরাকার হইয়াও সাকার, ইহাই তাঁহার অলৌকিক মায়া বা যোগ । উভয় স্বরূপেই তিনি পূর্ণ [ঈশোপনিষৎ, শান্তিপাঠ] । শ্রীকৃষ্ণ অবতার হইলেও ‘সর্ব অবতারী’ স্বয়ং ঈশ্বর ।
কিন্তু কোনো অবতারের যখন আবির্ভাব হয় তখন সকলে তাঁহাকে চিনে না, ঈশ্বর বলিয়াও গ্রহণ করে না । সেকালের ভীষ্মদেব শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর বলিয়া জানিতেন । পক্ষান্তরে শিশুপালাদি তাঁহাকে সামান্য মনুষ্য বলিয়াই মনে করিতেন ।
২৫) যোগ : কৌশল বা সাধন (যেমন দ্রোণাচার্য-বধের কৌশল); ঈশ্বরপ্রাপ্তির উপায় বা মার্গ (কর্মমার্গ) । যোগমায়া = যোগরূপ যে মায়া, ভগবানের সৃষ্টিকৌশল; যোগ শব্দের এই অর্থ ধরিয়াই ভগবানকে যোগেশ্বর, মহাযোগেশ্বর ইত্যাদি বলা হয় । – [লোকমান্য তিলক]
প্রাচীন টীকাকারগণের মতে যোগ = ত্রিগুণের যোগ অথবা ভগবানের সঙ্কল্প । সেই যোগরূপ যে মায়া অথবা ভগবানের সঙ্কল্পের বশবর্তিনী যে মায়া, তাহাই যোগমায়া ।
২৬) আমি সর্বজ্ঞ, কেননা আমি মায়ার অধীন নহি, আমি মায়াধীশ । কিন্তু জীব মায়াধীন, সুতরাং অজ্ঞ । কেবল আমার অনুগৃহীত ভক্তগণই আমার মায়া উত্তীর্ণ হইয়া আমাকে জানিতে পারে ।

BISHWASHWOR ROY. Powered by Blogger.