শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা: পঞ্চম অধ্যায় – সন্ন্যাসযোগ (গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)

Tags

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা: পঞ্চম অধ্যায় – সন্ন্যাসযোগ

(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)

Image result for bhagavad gita chapter 5
অর্জ্জুন উবাচ –
সন্ন্যাসং কর্ম্মণাং কৃষ্ণ পুনর্যোগঞ্চ শংসসি।
যচ্ছ্রেয় এতয়োরেকং তন্মে ব্রূহি সুনিশিতম্।।১
অর্থঃ- (১) অর্জ্জুন বলিলেন – হে কৃষ্ণ! তুমি কর্ম্মত্যাগ ও কর্ম্মযোগ উভয়ই বলিতেছ, এই উভয়ের মধ্যে যাহা শ্রেয়স্কর সেই একটি আমাকে নিশ্চয় করিয়া বল।
শ্রীভগবান্ উবাচ –
সন্নাসঃ কর্ম্মযোগশ্চ নিঃশ্রেয়সকরাবুভৌ।
তয়োস্তু কর্ম্মসন্ন্যাসাৎ কর্ম্মযোগো বিশিষ্যতে।।২
অর্থঃ- (২) সশ্রীভগবান্‌ কহিলেন, সন্ন্যাস ও কর্ম্মযোগ উভয়েই মোক্ষপ্রদ, কিন্তু উভয়ের মধ্যে কর্ম্মসন্ন্যাস অপেক্ষা কর্ম্মযোগই শ্রেষ্ঠ।
জ্ঞেয়ঃ স নিত্যসন্ন্যাসী যো ন দ্বেষ্টি ন কাঙ্ক্ষতি।
নির্দ্বন্দ্বো হি মহাবাহো সুখং বন্ধাৎ প্রমুচ্যতে।।৩
অর্থঃ- (৩) হে মহাবাহো, যিনি কোন কিছু আকাঙ্ক্ষা করেন না, দ্বেষ করেন না, তাহাকে নিত্যসন্ন্যাসী জানিও; তাদৃশ রাগদ্বেষাদি দ্বন্দ্বশূন্য শুদ্বচিত্ত পুরুষ অনায়াসে সংসারবন্ধন হইতে মুক্তি লাভ করেন।
সাংখ্যযোগৌ পৃথগ্ বালাঃ প্রবদন্তি ন পণ্ডিতাঃ।
একমপ্যাস্থিতঃ সম্যগুভয়োর্ব্বিন্দতে ফলম্।।৪
অর্থঃ- (৪) অজ্ঞ ব্যক্তিগণই সন্ন্যাস ও কর্ম্মযোগকে পৃথক্‌ বলিয়া থাকেন, পণ্ডিতগণ এরূপ বলেন না। ইহার একটা সম্যক্‌ অনুষ্টিত হইলে উভয়ের ফল (মোক্ষ) লাভ হয়।
যৎ সাংখ্যৈঃ প্রাপ্যতে স্থানং তদ্ যোগৈরপি গম্যতে।
একং সাংখ্যং চ যোগং চ যঃ পশ্যতি স পশ্যতি।।৫
অর্থঃ- (৫) সাংখ্যগণ যে স্থান লাভ করেন কর্ম্মযোগিগণও সেই স্থান প্রাপ্ত হন। যিনি সন্ন্যাস ও কর্ম্মযোগকে একরূপ দেখেন তিনিই যথার্থদর্শী।
সন্ন্যাসস্তু মহাবাহো দুঃখমাপ্ত মযোগতঃ।
যোগযুক্তো মুনির্ব্রহ্ম ন চিরেণাধিগচ্ছতি।।৬
অর্থঃ- (৬) হে মহাবাহো, কর্ম্মযোগ বিনা সন্ন্যাস কেবল দুঃখের কারণ হয়। কিন্তু কর্ম্মযোগযুক্ত সাধক অচিরেই ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার লাভ করেন।
যোগযুক্তো বিশুদ্ধাত্মা বিজিতাত্মা জিতেন্দ্রিয়ঃ।
সর্ব্বভূতাত্মভূতাত্মা কুর্ব্বন্নপি ন লিপ্যতে।।৭
অর্থঃ- (৭) যিনি কর্ম্মযোগে যুক্ত, বিশুদ্ধচিত্ত, সংযতদেহ, জিতেন্দ্রিয় এবং সর্বভূতের আত্মাই যাহার আত্মস্বরূপ, এরূপ সম্যগ্‌দর্শী পুরুষ কর্ম্ম করিয়াও কর্ম্মে আবদ্ধ হয়েন না।
নৈব কিঞ্চিৎ করোমীতি যুক্তো মন্যেত তত্ত্ববিৎ।
পশ্যন্ শৃণ্বন্ স্পৃশন্ জিঘ্রন্নশ্নন্ গচ্ছন্ স্বপন্ শ্বসন্।।৮
প্রলপন্ বিসৃজন্ গৃহ্নন্নুন্মিষন্নিমিষন্নপি।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেষু বর্ত্তন্ত ইতি ধারয়ন্।।৯
অর্থঃ- (৮-৯) কর্ম্মযোগে যুক্ত তত্ত্বদর্শী পুরুষ দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, ঘ্রাণ, ভোজন, গমন, নিদ্রা, নিঃশ্বাস গ্রহণ, কখন, ত্যাগ, গ্রহণ, উন্মেষ ও নিমেষ প্রভৃতি কার্য্য করিয়াও মনে করেন, – ইন্দ্রিয়সকলই ইন্দ্রিয়বিষয়ে প্রবৃত্ত হইতেছে, আমি কিছুই করিনা (ইন্দ্রিয়দ্বারা কর্ম্ম করিলেও কর্ত্তৃত্বাভিমান-বর্জ্জনহেতু তাহার কর্ম্মবন্ধন হয় না)।
ব্রহ্মণ্যাধায় কর্ম্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা করোতি যঃ।
লিপ্যতে ন স পাপেন পদ্মপত্রমিবাম্ভসা।।১০
অর্থঃ- (১০) যিনি ব্রহ্মে সমুদয় কর্ম্ম স্থাপনপূর্ব্বক ফলাসক্তি ও কর্ত্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করিয়া কর্ম্ম করেন, তিনি পাপে লিপ্ত হন না, যেমন পদ্মপত্র জলসংসৃষ্ট থাকিয়াও জলদ্বারা লিপ্ত হয় না।
কায়েন মনসা বুদ্ধ্যা কেবলৈরিন্দ্রিয়ৈরপি।
যোগিনঃ কর্ম্ম কুর্ব্বন্তি সঙ্গং ত্যক্ত্বাত্মশুদ্ধয়ে।।১১
অর্থঃ- (১১) কর্ম্মযোগিগণ ফলকামনা ও কর্ত্তৃত্বাভিনিবেশ পরিত্যাগ করিয়া চিত্তশুদ্ধির নিমিত্ত কেবল শরীর, মন, বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়াদি দ্বারা কর্ম্ম করিয়া থাকেন।
যুক্ত কর্ম্মফলং ত্যক্ত্বা শান্তিমাপ্নোতি নৈষ্ঠিকীম্।
অযুক্তঃ কামকারেণ ফলে সক্তো নিবধ্যতে।।১২
অর্থঃ- (১২) নিষ্কাম কর্ম্মযোগিগণ কর্ম্মফল ত্যাগ করিয়া সর্ব্বদুঃখ-নিবৃত্তিরূপ স্থিরা শান্তি লাভ করেন। সকাম বহির্মুখ ব্যক্তিগণ কামনাবশতঃ ফলে আসক্ত হইয়া বন্ধনদশা প্রাপ্ত হন।
সর্ব্বকর্ম্মাণি মনসা সংন্যস্যাস্তে সুখং বশী।
নবদ্বারে পুরে দেহী নৈব কুর্ব্বন্ ন কারয়ন্।।১৩
অর্থঃ- (১৩) জিতেন্দ্রিয় পুরুষ (কর্ম্মযোগী) মনে মনে সমস্ত কর্ম্ম ত্যাগ করিয়া নবদ্বারমুক্ত দেহে সুখে বাস করেন, তিনি কিছু করেন না, অন্যকেও কিছু করান না।
মনে মনে ত্যাগ করিয়া – অর্থাৎ কার্য্যতঃ ত্যাগ নহে।
কর্ম্মযোগীর কার্য্য কিরূপে হয় তাহাই এখানে বলা হইতেছে। তাঁহার দেহাদি কার্য্য করিতেছে; কিন্তু তিনি ত দেহ নন, তিনি দেহী অর্থাৎ আত্মা। আত্মা নির্লিপ্ত, তিনি কিছু করেন না, তাঁহার কর্ম্মজনিত বিক্ষেপ নাই, তিনি সুখে দেহমধ্যে অবস্থিত আছেন।
ন কর্ত্তৃত্বং ন কর্ম্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভুঃ।
ন কর্ম্মফলসংযোগং স্বভাবস্তু প্রবর্ত্ততে।।১৪
অর্থঃ- (১৪) প্রভু (আত্মা) লোকের কর্ত্তৃত্ব করেন না, কর্ম্ম সৃষ্টি করেন না, সুখদুঃখরূপ কর্ম্মফলসন্বন্ধও রচনা করেন না, কিন্তু প্রকৃতিই কর্ম্মে প্রবৃত্ত হয়।
নাদত্তে কস্যচিৎ পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভুঃ।
অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং তেন মুহ্যন্তি জন্তবঃ।।১৫
অর্থঃ- (১৫) সর্ব্বব্যাপী আত্মা কাহারও পাপ বা পুণ্য গ্রহণ করেন না; অজ্ঞান কর্ত্তৃক জ্ঞান আচ্ছন্ন থাকে বলিয়া জীব মোহপ্রাপ্ত হয়।
জ্ঞানেন তু তদজ্ঞানং যেষাং নাশিতমাত্মনঃ।
তেষামাদিত্যবজ্ জ্ঞানং প্রকাশয়তি তৎ পরম্।।১৬
অর্থঃ- (১৬) কিন্তু যাহাদের আত্ম-বিষয়ক জ্ঞানদ্বারা সেই অজ্ঞান বিনষ্ট হয় তাহাদিগের সেই আত্মজ্ঞান সূর্য্যবৎ পরম তত্ত্বকে প্রকাশ করিয়া দেয়, অর্থাৎ সূর্য্য যেরূপ তমোনাশ করিয়া সমস্ত বস্তু প্রকাশিত করেন, সেইরূপ আত্মজ্ঞান জীবের সমস্ত মোহ দূর করিয়া পরম পুরুষকে প্রকাশ করিয়া দেয়।
তদ্ বুদ্ধয়স্তদাত্মানস্তন্নিষ্ঠাস্তৎপরায়ণাঃ।
গচ্ছন্ত্যপুনরাবৃত্তিং জ্ঞাননির্ধুতকল্মষাঃ।।১৭
অর্থঃ- (১৭) যাঁহাদের নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি সেই পরম পুরুষেই নিবিষ্ট হইয়াছে, তাহাতেই যাঁহাদের আত্মভার, তাহাতেই যাঁহাদের নিষ্ঠা, তিনিই যাঁহাদের পরমগতি এবং অনুরক্তির বিষয়, তাঁহাদের আর পুনরায় দেহধারণ করিতে হয় না, কারণ জ্ঞানের দ্বারা তাঁহাদের সংসার-কারণ অজ্ঞান দূরীভূত হইয়াছে।
বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি।
শুনি চৈব শ্বপাকে চ পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ।।১৮
অর্থঃ- (১৮) বিদ্যাবিনয়যুক্ত ব্রাহ্মণে, চণ্ডালে, গো, হস্তী ও কুক্কুরে আত্মবিৎ পণ্ডিতগণ সমদর্শী।
আপাততঃ বিষম বস্তুতে সমদর্শন হয় কখন? যখন আত্মস্বরূপ বা ব্রহ্মস্বরূপ দর্শন হয়। আত্মজ্ঞানের ফলই সমত্ব। আত্মদর্শী পণ্ডিতগণ জগৎকে ব্রহ্ম-দৃষ্টিতে দেখেন। এই ব্রহ্মই নারায়ণ পদবাচ্য। তাঁহাদের দৃষ্টিতে ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, পাপী, পুণ্যবান, গাভী, হস্তী, কুক্কুর সকলই নারায়ণ।
ইহৈব তৈর্জিতঃ সর্গো যেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ।
নির্দ্দোষং হি সমং ব্রহ্ম তস্মাদ্ ব্রহ্মণি তে স্থিতাঃ।।১৯
অর্থঃ- (১৯) যাহাদিগের মন সাম্যে অবস্থিত অর্থাৎ সর্ব্ববিষয়ে বৈষম্য-রহিত, তাহারা ইহলোকে থাকিয়াই এই জনম-মরণ-রূপ সংসার অতিক্রম করেন; যেহেতু, ব্রহ্ম সম ও নির্দ্দোষ, সুতরাং সেই সমদর্শী পুরুষগণ ব্রহ্মেই অবস্থিতি করেন অর্থাৎ ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হয়েন।
ন প্রহৃষ্যেৎ প্রিয়ং প্রাপ্য নোদ্ বিজেৎ প্রাপ্য চাপ্রিয়ম্।
স্থিরবুদ্ধিরসংমূঢ়ো ব্রহ্মবিদ্ ব্রহ্মণি স্থিতঃ।।২০
অর্থঃ- (২০) ঈদৃশ ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি স্থিরবুদ্ধি, সর্ব্বপ্রকার মোহ-বর্জ্জিত এবং ব্রহ্মেই অবস্থিত অর্থাৎ ব্রহ্মভাবে ভাবিত; সুতরাং তিনি প্রিয়বস্তু লাভেও হৃষ্ট হন না, অপ্রিয় সমাগমেও উদ্বিগ্ন হন না (তিনি শুভাশুভ, প্রিয়াপ্রিয় ইত্যাদি দ্বন্দ্ববর্জ্জিত)।
বাহ্যস্পর্শেষ্বসক্তাত্মা বিন্দত্যাত্মনি যৎ সুখম্।
স ব্রহ্মযোগযুক্তাত্মা সুখমক্ষয়মশ্নুতে।।২১
অর্থঃ- (২১) বাহ্যবিষয়ে অনাসক্ত, ব্রহ্মে সমাহিতচিত্ত পুরুষ আত্মায় যে আনন্দ আছে তাহা লাভ করেন, তিনি অক্ষয় আনন্দ উপভোগ করেন।
যে হি সং স্পর্শজা ভোগা দুঃখযোনয় এব তে।
আদ্যন্তবন্তঃ কৌন্তেয় ন তেষু রমতে বুধঃ।।২২
অর্থঃ- (২২) বিষয়ভোগজনিত যে সকল সুখ সে সকল নিশ্চয়ই দুঃখের হেতু এবং আদি ও অন্তবিশিষ্ট (ক্ষণস্থায়ী, অনিত্য), বিবেকী ব্যক্তি উহাতে রত হন না।
শক্নোতীহৈব যঃ সোঢ়ুং প্রাক্ শরীরবিমোক্ষণাৎ।
কামক্রোধোদ্ভবং বেগং স যুক্তঃ স সুখী নরঃ।।২৩
অর্থঃ- (২৩) যিনি দেহত্যাগ করিবার পূর্ব্বে এই সংসারে থাকিয়াই কামক্রোধজাত বেগ প্রতিরোধ করিতে পারেন, তিনিই যোগী, তিনিই সুখী পুরুষ।
যোহন্তঃসুখোহন্তরারামস্তথান্তজ্যোতিরেব যঃ।
স যোগী ব্রহ্মনির্বাণং ব্রহ্মভূতোহধিগচ্ছতি।।২৪
অর্থঃ- (২৪) যাঁহার অন্তরে (আত্মাতেই) সুখ, যাঁহার অন্তরে (আত্মাতেই) আরাম ও শান্তি, যাঁহার অন্তরেই আলোক, সেই যোগী ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন।
লভন্তে ব্রহ্মনির্ব্বাণমৃষয়ঃ ক্ষীণকল্মষাঃ।
ছিন্নদ্বৈধা যতাত্মানঃ সর্ব্বভূতহিতে রতাঃ।।২৫
অর্থঃ- (২৫) যাঁহারা নিস্পাপ, সংশয়শূন্য, সংযতচিত্ত, সর্ব্বভূতহিতে রত, সেইরূপ ঋষিগণ ব্রহ্মনির্ব্বাণ প্রাপ্ত হন।
কামক্রোধবিযুক্তানাং যতীনাং যতচেতসাম্।
অভিতো ব্রহ্মনির্ব্বাণং বর্ত্ততে বিদিতাত্মনাম্।।২৬
অর্থঃ- (২৬) কামক্রোধবিমুক্ত, সংযতচিত্ত আত্মদর্শী যতিগণের ব্রহ্মনির্ব্বাণ নিকটেই, চারিদিকেই বর্ত্তমান অর্থাৎ তাঁহারা ব্রহ্মনির্ব্বাণের মধ্যেই বাস করেন।
স্পর্শান্ কৃত্বা বহির্বাহ্যাংশ্চক্ষুশ্চৈবান্তরে ভ্রূবোঃ।
প্রাণাপানৌ সমৌ কৃত্বা নাসাভ্যন্তরচারিণো।।২৭
যতেন্দ্রিয়মণোবুদ্ধির্মুনির্মোক্ষপরায়ণঃ।
বিগতেচ্ছাভয়ক্রোধো যঃ সদা মুক্ত এব সঃ।।২৮
অর্থঃ- (২৭-২৮) বাহ্যবিষয়সমূহ মন হইতে বহিস্কৃত করিয়া; – চক্ষুর্দ্বয়কে ভ্রুমধ্যে স্থাপন করিয়া, প্রাণ ও অপান বায়ুর ঊর্দ্ধ ও অধো গতি সমান করিয়া, উহাদিগকে নাসামধ্যে রাখিয়া যিনি ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধিকে সংযত করিযাছেন এবং যিনি মোক্ষপরায়ণ, ইচ্ছাভয়ক্রোধবর্জ্জিত ও আত্মমননশীল – তিনি সর্বদাই মুক্ত।
ভোক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্ব্বলোকমহেশ্বরম্।
সুহৃদং সর্ব্বভুতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি।।২৯
অর্থঃ- (২৯) মুক্ত যোগিপুরুষ আমাকে যজ্ঞ ও তপস্যাসমূহের ভোক্তা, সর্বলোকের মহেশ্বর এবং সর্ব্বলোকের সুহৃদ্‌ জানিয়া পরম শান্তি লাভ করেন।
ইতি শ্রীমদ্‌ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুন – সংবাদে সন্ন্যাসযোগো নাম পঞ্চমোহধ্যায়ঃ।

৩) নিত্যসন্য্যাসী = সংসারে থাকিয়া কর্মানুষ্ঠানকালেও সন্ন্যাসী
৬) শ্রীভগবান কর্ম রাখিলেন, যজ্ঞও রাখিলেন বটে, কিন্তু উহার অর্থের সম্প্রাসরণ করিলেন, ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জিত করিয়া মীমাংসকের স্বর্গপ্রদ কাম্যকর্মকে মোক্ষপ্রদ বিশুদ্ধ নিষ্কাম কর্মে পরিণত করিলেন, সঙ্গে-সঙ্গে কর্তৃত্বাভিমান-বর্জন ও সমত্ব-বুদ্ধির উপদেশ দিয়া কর্মকে জ্ঞানের সহিত সংযুক্ত করিয়া ব্রহ্মকর্ম বা বিশ্বকর্মে পরিণত করিলেন । জ্ঞান-কর্ম-ভক্তিমিশ্র যোগধর্ম – ইহা সম্পূর্ণই গীতার নিজস্ব ।
১০) ব্রহ্মণি আধায় : ব্রহ্মে কর্ম স্থাপন বা নিক্ষেপ করিয়া । ব্রহ্ম বলিতে অক্ষর নিষ্ক্রিয় পুরুষ বুঝায় । তাঁহাতে কর্মস্থাপন কিরূপ ? দেহ থাকিলে প্রকৃতির কর্ম চলিবেই, কিন্তু সেই কর্মে কোনো সংস্কার থাকিবে না – ইহাই ব্রহ্মজ্ঞানে অবস্থিত মুক্ত পুরুষের কর্ম । অজ্ঞানীর কর্ম স্থাপিত হয় অহং-এর উপর, জ্ঞানীর অহং-অভিমান না থাকাতে তাঁহার কর্ম স্থাপিত হয় ব্রহ্মের উপর ।
পুরুষোত্তম ও ব্রহ্ম ঠিক এক কথা নহে । পুরুষোত্তমে সগুণ-নির্গুণ দুই ভাবই আছে – অক্ষর ব্রহ্ম পুরুষোত্তমের নির্গুণ বিভাব । পুরুষোত্তমে কর্ম অর্পণই কর্মযোগের উদ্দেশ্য । ব্রহ্মে কর্ম স্থাপন, ঈশ্বরে কর্ম-সমর্পণের সহায়ক অনুষঙ্গী অবস্থা, কিন্তু দুইটি ঠিক এক নহে ।
The reposing of the work in the Impersonal (ব্রহ্মণি) is a means of getting rid of the personal egoism (অহংবুদ্ধি) of the doer, but the end is to give up all our actions to that great Lord of all (সর্বভূত-মহেশ্বর) – Essays on the Gita, Sri Aurobindo.
১৩) নবদ্বারে পুরে : দেহ নবদ্বারযুক্ত পুরী সদৃশ – দুই চক্ষু, দুই কর্ণ, দুই নাসারন্ধ্র, মুখ, পায়ু ও উপস্থ ।
মনস্য সংন্যস্য : মনে-মনে ত্যাগ করিয়া – অর্থাৎ কার্যত ত্যাগ নহে । কর্মযোগীর কার্য কিরূপে হয় তাহাই এখানে বলা হইতেছে । তাঁহার দেহাদি কার্য করিতেছে; কিন্তু তিনি ত দেহ নন, তিনি দেহী অর্থাৎ আত্মা । আত্মা নির্লিপ্ত, তিনি কিছু করেন না, তাঁহার কর্মজনিত বিক্ষেপ নাই, তিনি সুখে দেহমধ্যে অবস্থিত আছেন ।
১৫) আত্মতত্ত্ব ও ঈশ্বরতত্ত্ব :
এই অধ্যায়ের ১৩-১৪-১৫ শ্লোকে বর্ণিত তত্ত্বগুলি মূলত সাংখ্যশাস্ত্রের । সাংখ্যদর্শন নিরীশ্বর; উহার মূলে দুইটি তত্ত্ব – নিষ্ক্রিয় পুরুষ আর ক্রিয়াশীল প্রকৃতি । বেদান্তদর্শনের পরিভাষায় সাংখ্যের নিষ্ক্রিয় পুরুষ বা আত্মাই নির্গুণ ব্রহ্ম, আর প্রকৃতি হইতেছেন মায়া বা অজ্ঞান । মায়াতত্ত্ব অনুযায়ী এক ব্রহ্মই সত্য । বেদান্তে ব্রহ্মের নির্গুণ-সগুণ দুই বিভাবেরই বর্ণনা আছে এবং গীতাও তাহাই অনুসরণ করিয়াছেন । শ্রীগীতা অনুযায়ী অজ্ঞান অর্থ জ্ঞানের অভাব বা ভ্রান্ত জ্ঞান । ঈশ্বরই পরতত্ত্ব, পরমাত্মা, পুরুষোত্তম । সাংখ্যের পুরুষ ও প্রকৃতি তাঁরই পরা ও অপরা প্রকৃতি, শক্তি বা বিভাব ।
১৮) আপাততঃ বিষম বস্তুতে সমদর্শন হয় কখন ? যখন আত্মস্বরূপ বা ব্রহ্মস্বরূপ দর্শন হয় । আত্মজ্ঞানের ফলই সমত্ব । আত্মদর্শী পণ্ডিতগণ জগৎকে ব্রহ্ম-দৃষ্টিতে দেখেন । এই ব্রহ্মই নারায়ণ পদবাচ্য । তাঁহাদের দৃষ্টিতে ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, পাপী, পুণ্যবান, গাভী, হস্তী, কুক্কুর সকলই নারায়ণ ।
২৪, ২৫, ২৯) অভিতঃ : ব্রহ্মনির্বাণ ইঁহাদিগের হস্তস্তিত এই অর্থ । The Nirvana in the Brahman exists all about them (অভিতঃ বর্ততে), for it is the Brahma-consciousness in which they live . – Sri Aurobindo.
ব্রহ্মনির্বাণম্‌ : ব্রহ্মে নিবৃত্তি বা লয় । মায়াধীন জীবচৈতন্যের, উচ্চতর অন্তরাত্মাতে নীচের অহঙ্কার বা ‘আমি’র লয় – The extinction of the ego in the higher spiritual inner Self. – Sri Aurobindo.
ব্রহ্মনির্বাণ লাভ করিয়াও ঋষিগণ সর্বভূতহিত-সাধনে নিযুক্ত থাকেন [গী|৫|২৫] । ‘এই অধ্যায়ের আরম্ভে কর্মযোগকে শ্রেষ্ঠ স্থির করিয়া আবার ২৫শ শ্লোকে বলা হইয়াছে যে, জ্ঞানী পুরুষ সকল প্রাণীর হিতসাধনে প্রত্যক্ষভাবে মগ্ন থাকেন, ইহা হইতেই প্রকাশ পাইতেছে যে, এই সমস্ত বর্ণনা কর্মযোগী জীবন্মুক্তেরই, সন্ন্যাসীর নহে ।’ – লোকমান্য তিলক (গীতারহস্য)
‘সংসার ও সংসারের কাজের সহিত নির্বাণের কোনো বিরোধই নাই । কারণ, যে সকল ঋষি এই নির্বাণ লাভ করিয়াছেন তাঁহারা ক্ষরজগতের মধ্যে ভগবানকে দেখিতে পান এবং কর্মের দ্বারা তাঁহার সহিত নিবিড়ভাবে সংযুক্ত থাকেন, তাঁহারা সর্বভূতের হিতসাধনে নিযুক্ত থাকেন । … ক্ষর পুরুষের লীলাকে তাঁহারা পরিত্যাগ করেন নাই, দিব্যলীলায় পরিণত করিয়াছেন ।’ – শ্রীঅরবিন্দের গীতা ।
নির্বাণবাদ : নির্বাণ শব্দটি বৌদ্ধধর্ম-প্রসঙ্গে বিশেষ পরিচিত । এই নির্বাণবাদকে অনেকে শূন্যবাদও বলেন । বেদান্তের নির্বিশেষ ব্রহ্মতত্ত্ব বুঝাইতেও ‘শূন্য’ শব্দ বহু শাস্ত্রগ্রন্থে (মৈত্রায়ণী উপনিষদ, উত্তরগীতা, তেজবিন্দু উপনিষদ, শিবসংহিতা ইত্যাদি) ব্যবহৃত হইয়াছে ।
নির্গুণ নির্বিশেষ পরতত্ত্ব মনে ধারণা করা যায় না, বাক্যে প্রকাশ করা যায় না । তাহা কথায় ব্যক্ত করিতে হইলে ‘শূন্য’ কথাটিই উপযোগী হয়; উহা অবস্তু বা অভাবাত্মক কিছু নহে । এই কারণেই বৌদ্ধদর্শনেও ধারণার অতীত অজ্ঞেয় পরতত্ত্বকে ‘শূন্য’ বলিয়া নির্দেশ করা হইয়াছে । ইহা প্রকৃতপক্ষে নাস্তিক্যবাদ নয় । বৌদ্ধের ‘শূন্য’, আর গুণশুন্য (নির্গুণ) ব্রহ্ম প্রায় এক কথাই । গীতায় ব্রহ্মনির্বাণ বা ব্রাহ্মীস্থিতিই সাধনার চরম কথা বা মোক্ষ নহে । পুরুষোত্তম স্বয়ং ভগবানের স্বরূপ জ্ঞান এবং তাঁহাতে পরাভক্তিই গীতার শেষ কথা ।
‘এই অবস্থা ব্রহ্মভূত হওয়ারও পরের অবস্থা । গীতায় স্থানে-স্থানে ব্রাহ্মীস্থিতি, ব্রহ্মনির্বাণ প্রভৃতির যে উল্লেখ আছে, ইহা সাধনার খুব উচ্চ অবস্থা বটে, কিন্তু সাধকের চরম নহে । গীতা তাহারও পরের অবস্থা বর্ণনা করিয়াছেন । বেদান্তদর্শন জীবকে ব্রহ্মলোক অবধি লইয়া গিয়াছেন – গীতা কিন্তু জীবকে ঈশ্বরের সহিত মিলিত করিয়া দিয়াছেন ।’ – ‘গীতায় ঈশ্বরবাদ’, বেদান্তরত্ন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ।
‘But the Gita is going to represent the Iswara, the Purushottama, as higher even than the still and immutable Brahma (সম, শান্ত, অক্ষর ব্রহ্ম) and the loss of the ego in the Impersonal (ব্রহ্মনির্বাণ) comes in the beginning only as a great and initial step towards union with Purushottama. This is the Supreme Divine, God, who possesses both the infinite and the finite and in whom the personal and the Impersonal, the one self and the many existences… are united.’ – Essays on the Gita, Sri Aurobindo.
‘পূর্ণযোগের দ্বারা পুরুষোত্তমের সহিত জীবাত্মার মিলনই গীতার সম্পূর্ণ শিক্ষা নহে । এই জ্ঞানের পথে কেবল অক্ষর ব্রহ্মের সহিত মিলনের যে সঙ্কীর্ণতম মত, তাহা গীতার শিক্ষা নহে । এই জন্যই গীতা প্রথমে জ্ঞান ও কর্মের সামঞ্জস্য করিয়া পরে দেখাইতে পারিয়াছে যে, জ্ঞান ও কর্ম উভয়ের সহিত সমন্বিত প্রেম ও ভক্তি উত্তম রহস্য পথে চরম অবস্থা । – শ্রীঅরবিন্দের গীতা ।

BISHWASHWOR ROY. Powered by Blogger.