শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : চতুর্দশ অধ্যায় – গুণত্রয়-বিভাগযোগ (গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)

Tags

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : চতুর্দশ অধ্যায় – গুণত্রয়-বিভাগযোগ
(গীতাশাস্ত্রী জগদীশচন্দ্র ঘোষ)

Image result for bhagavad gita chapter 13
শ্রীভগবানুবাচ –
পরং ভূয়ঃ প্রবক্ষ্যামি জ্ঞানানাং জ্ঞানমুত্তমম্।
যজ্ জ্ঞাত্বা মুনয়ঃ সর্ব্বে পরাং সিদ্ধিমিতো গতাঃ।।১
অর্থঃ-(১) শ্রীভগবান্‌ কহিলেন,- আমি পুনরায় জ্ঞানসমূহের মধ্যে সর্ব্বোত্তম জ্ঞান বলিতেছি, যাহা জানিয়া মুনিগণ এই দেহবন্ধন হইতে মোক্ষ লাভ করিয়াছেন।
ইদং জ্ঞানমুপাশ্রিত্য মম সাধর্ম্ম্যমাগতাঃ।
সর্গেহপি নোপজায়ন্তে প্রলয়ে ন ব্যথন্তি চ।।২
সাধর্ম্ম্য – স্বরূপতা অর্থাৎ আমি যেমন ত্রিগুণাতীত এইরূপ ত্রিগুণাতীত অবস্থা।
অর্থঃ-(২) এই জ্ঞান আশ্রয় করিয়া যাহারা আমার সাধর্ম্ম্য লাভ করেন অর্থাৎ ত্রিগুণাতীত অবস্থা প্রাপ্ত হন, তাঁহারা সৃষ্টিকালেও জন্মগ্রহণ করেন না, প্রলয়কালেও ব্যথিত হন না (অর্থাৎ জন্মমৃত্যু অতিক্রম করেন)।
মম যোনির্মহদ্ ব্রহ্ম তস্মিন্ গর্ভং দধাম্যহম্।
সম্ভবঃ সর্ব্বতভূতানাং ততো ভবতি ভারত।।৩
অর্থঃ-(৩) হে ভারত, প্রকৃতিই আমার গর্ভাধান-স্থান। আমি তাহাতে গর্ভাধান করি, তাহা হইতেই সর্ব্বভূতের উৎপত্তি হয়।
সর্ব্বযোনিষু কৌন্তেয় মূর্ত্তয়ঃ সম্ভবন্তি যাঃ।
তাসাং ব্রহ্ম মহদ্ যোনিরহং বীজপ্রদঃ পিতা।।৪
অর্থঃ-(৪) হে কৌন্তেয়, দেবমনুষ্যাদি বিভিন্ন যোনিতে যে সকল শরীর উৎপন্ন হয়, প্রকৃতি তাহাদের মাতৃস্থানীয়া এবং আমিই গর্ভাধানকর্ত্তা পিতা।
এই গর্ভাধান কি তাহা পূর্ব শ্লোকে বলা হইয়াছে। বেদান্তে ইহাকেই ঈক্ষণ বলে।
সত্ত্বং রজস্তম ইতি গুণাঃ প্রকৃতিসম্ভবাঃ।
নিভধ্নন্তি মহাবাহো দেহে দেহিনমব্যয়ম্।।৫
অর্থঃ-(৫) হে মহাবাহো, সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ, প্রকৃতিজাত এই গুণত্রয় দেহমধ্যে অব্যয় আত্মাকে বন্ধন করিয়া রাখে।
জীবাত্মা অবিকারী হইলেও প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতঃ দেহাত্মভাব প্রাপ্ত হওয়ার সুখ-দুঃখ মোহাদিতে জড়িত হইয়া পড়েন। ৫।৬।৭।৮ এই চারিটি শ্লোকে ত্রিগুণের বন্ধ অর্থাৎ প্রকৃতি-সংযোগে পুরুষের সংসারবন্ধন বর্ণনা হইতেছে।
তত্র সত্ত্বং নির্ম্মলত্বাৎ প্রকাশকমনাময়ম্।
সুখসঙ্গেন বধ্নাতি জ্ঞানসঙ্গেন চানঘ।।৬
অর্থঃ-(৬) হে অনদ, এই তিন গুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ নির্ম্মল বলিয়া প্রকাশক এবং নির্দ্দোষ; এই সত্ত্বগুণ সুখসঙ্গ ও জ্ঞানসঙ্গ-দ্বারা আত্মাকে বন্ধন করিয়া রাখে।
রজো রাগাত্মকং বিদ্ধি তৃষ্ণাসঙ্গসমুদ্ভবম্।
তন্নিবধ্নাতি কৌন্তেয় কর্ম্মসঙ্গেন দেহিনম্।।৭
অর্থঃ-(৭) হে অর্জ্জুন, রজোগুণ রাগাত্মক; তৃষ্ণা ও আসক্তি উহা হইতে উৎপন্ন হয়। উহা কর্ম্মশক্তি দ্বারা দেহীকে বন্ধন করে।
তমস্ত্বজ্ঞানজং বিদ্ধি মোহনং সর্ব্বদেহিনাম্।
প্রমাদালস্যনিদ্রাভিস্তন্নিবধ্নাতি ভারত।।৮
অর্থঃ-(৮) হে ভারত, তমোগুণ অজ্ঞানজাত এবং দেহীগণের ভ্রান্তিজনক। ইহা প্রমাদ (অনবধানতা), আলস্য ও নিদ্রা (চিত্তের অবসাদ) দ্বারা জীবনকে আবদ্ধ করে।
সত্ত্বং সুখে সঞ্জয়তি রজঃ কর্ম্মণি ভারত।
জ্ঞানমাবৃত্য তু তমঃ প্রমাদে সঞ্জয়ত্যুত।।৯
অর্থঃ-(৯) হে ভারত, সত্ত্বগুণ সুখে এবং রজোগুণ কর্ম্মে জীবকে আসক্ত করে। কিন্তু তমোগুণ জ্ঞানকে আবৃত করিয়া প্রমাদ (কর্ত্তব্যমূঢ়তা বা অনবধাবতা) উৎপন্ন করে।
রজস্তমশ্চাভিভূয় সত্ত্বং ভবতি ভারত।
রজঃ সত্ত্বং তমশ্চৈব তমঃ সত্ত্বং রজস্তথা।।১০
অর্থঃ-(১০) হে ভারত, সত্ত্বগুণ রজঃ ও তমোগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয়, রজোগুণ তমঃ ও সত্ত্বগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয় এবং তমোগুণ রজঃ ও সত্ত্বগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয়।
এই কয়েকটি শ্লোকে (১০ম-১৩শ) সাত্ত্বিক, রাজস ও তামস এই ত্রিবিধ স্বভাবের লক্ষণ – বলা হইতেছে।
সর্ব্বদ্বারেষু দেহেহস্মিন্ প্রকাশ উপজায়তে।
জ্ঞানং যদা তদা বিদ্যাদ্ বিবৃদ্ধিং সত্ত্বমিত্যুত।।১১
অর্থঃ-(১১) যখনই এই দেহে শ্রোত্রাদি সর্ব্ব ইন্দ্রিয়দ্বারে জ্ঞানাত্মক প্রকাশ অর্থাৎ নির্ম্মল জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তখন জানিবে যে সত্ত্বগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়াছে।
লোভঃ প্রবৃত্তিরারন্মঃ কর্ম্মণামশমঃ স্পৃহা।
রজস্যেতানি জায়ন্তে বিবৃদ্ধে ভরতর্ষভ।।১২
অর্থঃ-(১২) হে ভরতশ্রেষ্ঠ, লোভ, সর্ব্বদা কর্ম্মে প্রবৃত্তি এবং সর্ব্ব কর্ম্মে উদ্যম, শান্তি ও তৃপ্তির অভাব, বিষয়স্পৃহা – এই সকল লক্ষণ রজোগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইলে উৎপন্ন হয়।
অপ্রকাশোহপ্রবৃত্তিশ্চ প্রমাদো মোহ এব চ।
তমস্যেতানি জায়ন্তে বিবৃদ্ধে কুরুনন্দন।।১৩
অর্থঃ-(১৩) হে কুরুনন্দন, তমোগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইলে বিবেক-ভ্রংশ, নিরুদ্যমতা, কর্ত্তব্যের বিস্মরণ এবং মোহ বা বুদ্দি-বিপর্য্যয় – এই সকল লক্ষণ উৎপন্ন হয়।
যদা সত্ত্বে প্রবৃদ্ধে তু প্রলয়ং যাতি দেহভূৎ।
তদোত্তমবিদাং লোকানমলান্ প্রতিপদ্যতে।।১৪
অর্থঃ-(১৪) সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইলে যদি জীবের মৃত্যু হয়, তবে তিনি তত্ত্ববিদ্‌গণের প্রাপ্য প্রকাশময় দিব্য লোকসকল প্রাপ্ত হন।
রজসি প্রলয়ং গত্বা কর্ম্মসঙ্গিষু জায়তে।
তথা প্রলীনস্তমসি মূঢ়যোনিষু জায়তে।।১৫
অর্থঃ-(১৫) রজোগুণের বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হইলে কর্ম্মাসক্ত মনুষ্য-যোনিতে জন্ম হয় এবং তমোগুণের বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হইলে পশ্বাদি মূঢ় যোনিতে জন্ম হয়।
কর্ম্মণঃ সুকৃতস্যাহুঃ সাত্ত্বিকং নির্ম্মলং ফলম্।
রজসস্তু ফলং দুঃখমজ্ঞানং তমসঃ ফলম্।।১৬
অর্থঃ-(১৬) সাত্ত্বিক পুণ্য কর্ম্মের ফল নির্ম্মল সুখ, রাজসিক কর্ম্মের ফল দুঃখ এবং তামসিক কর্ম্মের ফল অজ্ঞান, এইরূপ তত্ত্বদর্শিগণ বলিয়া থাকেন।
সত্ত্বাৎ সংজায়তে জ্ঞানং রজসো লোভ এবচ।
প্রমাদমোহৌ তমসো ভবতোহজ্ঞানমেব চ।।১৭
অর্থঃ-(১৭) সত্ত্বগুণ হইতে জ্ঞান উৎপন্ন হয়; এবং রজোগুণ হইতে লোভ এবং তমোগুণ হইতে অজ্ঞান, প্রমাদ ও মোহ উৎপন্ন হইয়া থাকে।
ঊর্দ্ধং গচ্ছন্তি সত্ত্বস্থা মধ্যে তিষ্ঠন্তি রাজসাঃ।
জঘন্যগুণবৃত্তিস্থা অধো গচ্ছন্তি তামসাঃ।।১৮
অর্থঃ-(১৮) সত্ত্বগুণপ্রধান ব্যক্তি ঊর্দ্ধলোকে অর্থাৎ স্বর্গাদি লোকে গমন করেন; রজঃ প্রধান ব্যক্তিগণ মধ্যলোকে অর্থাৎ ভূলোকে অবস্থান করেন; এবং প্রমাদ মোহাদি নিকৃষ্টগুণ-সম্পন্ন তমঃপ্রধান ব্যক্তিগণ অধোগামী হয় (তামিস্রাদি নরক বা পশ্বাদি যোনি প্রাপ্ত হয়)।
নান্যং গুণেভ্যঃ কর্ত্তারং যদা দ্রষ্টানুপশ্যতি।
গুণেভ্যশ্চ পরং বেত্তি মদ্ভাবং সোহধিগচ্ছতি।।১৯
অর্থঃ-(১৯) যখন দ্রষ্টা জীব, গুণ ভিন্ন অন্য কাহাকেও কর্তা না দেখেন (অর্থাৎ প্রকৃতিই কর্ম করে, আমি করি না, ইহা বুঝিতে পারেন) এবং ত্রিগুণের অতীত পরম বস্তুকে অর্থাৎ আত্মাকে জ্ঞাত হন, তখন আমার ভাব অর্থাৎ ব্রহ্মভাব বা ত্রিগুণাতীত অবস্থা প্রাপ্ত হন।
গুণানেতানতীত্য ত্রীন্ দেহী দেহসমুদ্ভবান্।
জন্মমৃত্যুজরাদুঃখৈর্বিমুক্তোহমৃতমশ্নুতে।।২০
অর্থঃ-(২০) জীব দেহোৎপত্তির কারণভূত এই তিন গুণ অতিক্রম করিয়া জন্মমৃত্যুজরাদুঃখ হইতে বিমুক্ত হইয়া অমৃতত্ব অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করেন।
অর্জ্জুন উবাচ –
কৈর্লিঙ্গৈর্স্ত্রিন্ গুণানেতানতীতো ভবতি প্রভো।
কিমাচারঃ কথং চৈতাংস্ত্রীন্ গুণানতিবর্ত্ততে।।২১
অর্থঃ-(২১) অর্জুন কহিলেন, – হে প্রভো, কোন্‌ লক্ষণের দ্বারা জানা যায় যে জীব ত্রিগুণ অতিক্রম করিয়াছেন? তাহার আচার কিরূপ? এবং কি প্রকারে তিনি ত্রিগুণ অতিক্রম করেন।
শ্রীভগবানুবাচ –
প্রকাশঞ্চ প্রবৃত্তিঞ্চ মোহমেব চ পাণ্ডব।
ন দ্বেষ্টি সংপ্রবৃত্তানি ন নিবৃত্তানি কাঙ্ক্ষতি।।২২
অর্থঃ-(২২) শ্রীভগবান্‌ বলিলেন, – হে পাণ্ডব, সত্ত্বগুণের কার্য্য প্রকাশ বা জ্ঞান, রজোগুণের ধর্ম্ম-কর্ম্ম-প্রবৃত্তি এবং তমোগুণের ধর্ম্ম মোহ, এই সকল গুণধর্ম্ম প্রবৃদ্ধি হইলেও যিনি দুঃখবুদ্ধিতে দ্বেষ করেন না এবং ঐ সকল কার্য্য নিবৃত্ত থাকিলে যিনি সুখবুদ্ধিতে উহা আকাঙ্খা করেন না, তিনিই গুণাতীত বলিয়া উক্ত হন।
উদাসীনবদাসীনো গুণৈর্যো ন বিচাল্যতে।
গুণা বর্ত্তন্ত ইত্যেব যোহবতিষ্ঠতি নেঙ্গতে।।২৩
অর্থঃ-(২৩) যিনি উদাসীনের ন্যায় সাক্ষীস্বরূপ অবস্থান করেন, সত্ত্বাদিগুণকার্য্য সুখ-দুঃখাদি কর্ত্তৃক বিচলিত হন না, গুণ সকল স্ব স্ব কার্য্যে বর্ত্তমান আছে, আমার সহিত ইহার কোন সম্পর্ক নাই, ইহা মনে করিয়া যিনি চঞ্চল হন না, তিনি গুণাতীত বলিয়া কথিত হন।
সমদুঃখসুখঃ স্বস্থঃ সমলোষ্টাশ্মকাঞ্চনঃ।
তুল্যপ্রিয়াপ্রিয়ো ধীরস্তুল্যনিন্দাত্মসংস্তুতিঃ।।২৪
অর্থঃ-(২৪) যাহার নিকট সুখদুঃখ সমান, যিনি স্ব-স্ব অর্থাৎ আত্মস্বরূপেই স্থিত, মৃত্তকা, প্রস্তর ও সুবর্ণ যাহার নিকট সমান, যিনি প্রিয় ও অপ্রিয় এবং আপনার নিন্দা ও প্রশংসা তুল্য মনে করেন, যিনি ধীমান্‌ বা ধৈর্য্যযুক্ত, তিনিই গুণাতীত বলিয়া অভিহিত হন।
মানাপমানয়োস্তুল্যস্তুল্যো মিত্রারিপক্ষয়োঃ।
সর্ব্বারম্ভপরিত্যাগী গুণাতীতঃ স উচ্যতে।।২৫
অর্থঃ-(২৫) মান ও অপমানে, শত্রুপক্ষ ও মিত্রপক্ষে যাঁহার তুল্য জ্ঞান এবং ফলাকাঙ্ক্ষা করিয়া যিনি কোন কর্ম্মোদ্যম করেন আন, এরূপ ব্যক্তি গুণাতীত বলিয়া কথিত হন।
মাঞ্চ যোহব্যভিচারেণ ভক্তিযোগেন সেবতে।
স গুণান্ সমতীত্যৈতান্ ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে।।২৬
অর্থঃ-(২৬) যিনি ঐকান্তিক অভিযোগ সহকারে আমার সেবা করেন, তিনি এই তিন গুণ অতিক্রম করিয়া ব্রহ্মভাব লাভে সমর্থ হন।
ব্রহ্মণো হি প্রতিষ্ঠাহমমৃতস্যাব্যয়স্য চ।
শাশ্বতস্য চ ধর্ম্মস্য সুখস্যৈকান্তিকস্যচ।।২৭
অর্থঃ-(২৭) যেহেতু আমি ব্রহ্মের, নিত্য অমৃতের অর্থাৎ মোক্ষের, সনাতন ধর্ম্মের এবং ঐকান্তি সুখের প্রতিষ্ঠা, (অথবা আমি অমৃত ও অব্যয় ব্রহ্মের, শাশ্বত ধর্ম্মের এবং ঐকান্তিক সুখের প্রতিষ্ঠা।
এই অধ্যায়ে প্রধানতঃ ত্রিগুণতত্ত্বই বর্ণিত হইয়াছে, এই হেতু ইহাকে গুণত্রয়বিভাগযোগ বলে।
ইদি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে গুণত্রয়বিভাগযোগো নাম চতুর্দ্দশোহধ্যায়ঃ।


(১) পূর্ব অধ্যায়ে বলা হইয়াছে, সকল কর্ত্রিত্বই প্রকৃতির, পুরুষ অকর্তা । প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতঃই জীবের সদসদ্‌ যোনিতে জন্ম ও সুখ-দুঃখ ভোগ অর্থাৎ সংসারিত্ব । এই গুণ কি, উহাদের লক্ষণ কি, উহারা কি ভাবে জীবকে আবদ্ধ করে, কিরূপে প্রকৃতি হইতে বিবিধ সৃষ্টি হয়, ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই বলা হয় নাই । সেই হেতু এই প্রকৃতি-তত্ত্ব বা ত্রিগুণ-তত্ত্বই আবার বলিতেছেন ।
(২) সাধর্ম্য = স্বরূপতা অর্থাৎ আমি যেমন ত্রিগুণাতীত এইরূপ ত্রিগুণাতীত অবস্থা ।
(৩,৪) মহদ্‌ব্রহ্ম = প্রকৃতি; ‘গর্ভাধান করি’ = সর্বভূতের জন্মকারণ স্বরূপ বীজ প্রকৃতিরূপ যোনিতে আধান করি । ভূতগণকে তাহাদের স্বীয় প্রাক্তন কর্মানুসারে ক্ষেত্রের সহিত সংযোজিত করি । অথবা প্রকৃতিতে আমার সঙ্কল্পিত বীজ আধান করি অর্থাৎ আমার সঙ্কল্পানুসারেই প্রকৃতি সৃষ্টি করে । ঈশ্বরের সৃষ্টি-সঙ্কল্পই গর্ভাধানস্বরূপ – প্রকৃতির স্বতন্ত্র সৃষ্টি-সামর্থ্য নাই । বেদান্তে ইহাকেই ‘ঈক্ষণ’ বলে (জ্ঞান-বিজ্ঞান-যোগে ‘সাংখ্যের সৃষ্টিতত্ত্ব – প্রকৃতি ও পুরুষ’ দ্রষ্টব্য) ।
(৫) জীবাত্মা অবিকারী হইলেও প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতঃ দেহাত্মভাব প্রাপ্ত হওয়ায় সুখ-দুঃখ মোহাদিতে জড়িত হইয়া পড়েন । ত্রিগুণের বন্ধন = প্রকৃতি-সংযোগে পুরুষের সংসারবন্ধন ।
(৬) সত্ত্বগুণের বন্ধন – সত্ত্বগুণের মুখ্য ধর্ম – সুখ ও জ্ঞান – এই দুইটিও বন্ধনের কারণ বলা হইতেছে । সত্ত্বগুণ দুই প্রকার – (i) মিশ্রসত্ত্ব অর্থাৎ রজস্তমো-মিশ্রিত সত্ত্ব এবং (ii) শুদ্ধসত্ত্ব অর্থাৎ রজস্তমো-বর্জিত সত্ত্ব । রজস্তমোবর্জিত বিশুদ্ধ সত্ত্বগুণের লক্ষণ = নিস্ত্রৈগুণ্য বা ত্রিগুণাতীতের অবস্থা অর্থাৎ নির্দ্বন্দ্বভাব, বিমল সদানন্দ এবং অপরোক্ষ আত্মানুভূতির অবস্থা । গীতায় নিস্ত্রৈগুণ্য বলিতে ‘নিত্য শুদ্ধসত্ত্বগুণাশ্রিত’ বুঝায় । এই হেতুই ২|৪ শ্লোকে শ্রীভগবান অর্জুনকে ‘নিস্ত্রৈগুণ্য’ হইতে বলিয়াও ‘নিত্যসত্ত্বস্থ’ হইতে বলিয়াছেন ।
সত্ত্বগুণ জলের ন্যায় নির্মল হইলেও অপর দুইটির সহিত মিশ্রিত থাকায় উহা বন্ধনের কারণ হয় । “সত্ত্বগুণের খুব প্রাধান্য হইলেও তাহা প্রকৃত স্বাধীনতার অবস্থা নহে কারণ অন্যান্য গুণের ন্যায়ই বাসনা (মহত্তর) ও অহঙ্কারের (শুদ্ধতর) দ্বারাই বন্ধন করে । সাত্ত্বিক অহঙ্কারের উদাহরণ – আমি সাধু, আমি জ্ঞানী । প্রকৃত স্বাধীনতা, চরম স্বরাজ্য তখনই আরম্ভ হইবে যখন প্রাকৃত আত্মার উপরে আমরা পরমাত্মাকে দেখিতে পাইব, ধরিতে পারিব । আমাদের ক্ষুদ্র ‘আমি’ – আমাদের অহঙ্কার এই পরমাত্মাকে দেখিতে দেয় না । ইহার জন্য আমাদিগকে গুণত্রয়ের বহু ঊর্ধ্বে উঠিতে হইবে, ত্রিগুণাতীত হইতে হইবে, কারণ পরমাত্মা সত্ত্বগুণেরও উপরে ।” …[abridged from শ্রীঅরবিন্দের গীতা (অনিলবরণ)] ।
(১০-১৩) সত্ত্বগুণ, রজোগুণ ও তমোগুণ কখনও পৃথক্‌ পৃথক্‌ থাকে না, একত্রেই থাকে । কিন্তু জীবের পূর্ব কর্মানুসারে অদৃষ্টবশে কখনও সত্ত্বগুণ অপর দুইটিকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয় এবং জীবকে সুখাদিতে আসক্ত করে । এইরূপ কোথাও রজোগুণ প্রবল হইয়া কর্মাসক্তি, বিষয়-স্পৃহা, অস্থিরতা জন্মায় বা তমোগুণ প্রবল হইয়া নিদ্রা, অনুদ্যম, প্রমাদ, কর্তব্যের বিস্মৃতি, বুদ্ধি-বিপর্যয়, আলস্যাদি উৎপন্ন করে । এই হেতুই জীবের সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক এইরূপ বিভিন্ন প্রকৃতি বা স্বভাব দৃষ্ট হয় ।
(১৮) সত্ত্বগুণ-প্রধান ব্যক্তিগণ স্বর্গাদি দিব্যলোক প্রাপ্ত হন । কিন্তু তাহা হইলেও তাহাদের মোক্ষলাভ বা ভগবৎপ্রাপ্তি ঘটে না । ঐ সকল লোক হইতেও পতন আছে । তবে মোক্ষলাভ কিসে হয় ? – পরের দুই শ্লোক ।
(২০) প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতঃই জীবের দেহোৎপত্তি ও সংসারিত্ব । এই ত্রিগুণ অতিক্রম করিতে পারিলেই মোক্ষ । তাহার উপায় কি ? সাংখ্যদর্শন বলেন যে, জীব যখন বুঝিতে পারে যে প্রকৃতি পৃথক্‌, আমি পৃথক্‌, তখনই তাহার মুক্তি হয় । কিন্তু বেদান্ত ও গীতা সাংখ্যের এই প্রকৃতি-পুরুষরূপী দ্বৈতকে মূল তত্ত্ব বলিয়া স্বীকার করেন না । সুতরাং এই কথাটিই গীতায় এইরূপ ভাবে বলা হয় যে, প্রকৃতি ও পুরুষের উপরে যে পরমাত্মা বা পুরুষোত্তম আছেন, সেই পরমাত্মাকে যখন জীব জানিতে পারে, তখনই তাহার মোক্ষ বা ব্রহ্মলাভ হয় ।
(২১) ব্রাহ্মীস্থিতি = স্থিতপ্রজ্ঞ অথবা ত্রিগুণাতীতের অবস্থা
(২২,২৩) দেহে প্রকৃতির কার্য চলিতেছে চলুক । আমি উহাতে লিপ্ত নই । আমি অকর্তা, উদাসীন্, সাক্ষিস্বরূপ । এই জ্ঞান যাঁহার হইয়াছে তিনিই ত্রিগুণাতীত ।
(২৫) আরম্ভ = ঐহিক বা পারত্রিক ফল কামনা করিয়া কর্মের উদ্যোগ । সর্বারম্ভপরিত্যাগী = এইরূপ আরম্ভ যিনি করেন না । উদাহরণ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ।
(২৭) আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা – ভগবৎ-তত্ত্ব ও ব্রহ্মতত্ত্ব
সাংখ্যমতে ত্রিগুণাতীত হইয়া বা কৈবল্য লাভের একমাত্র উপায় পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের জ্ঞান [সাংখ্যসূত্র ৩|২৩] । পাতঞ্জলমতে ধ্যান-ধারণা ও পরিশেষে নির্বীজ সমাধি; সাংখ্যে যাহাকে প্রকৃতি বলে, অদ্বৈত বেদান্তে তাহাই অজ্ঞান বা মায়া । বেদান্ত মতেও জ্ঞানই ব্রহ্মভাব বা মোক্ষলাভের উপায়, ব্রহ্মসূত্রে কোথাও ‘ভক্তি’ শব্দ নাই । কিন্তু এস্থলে ভগবান্‌ বলিতেছেন – ত্রিগুণাতীত হইয়া ব্রহ্মভাব লাভের উপায় আমাতে অব্যভিচারিণী ভক্তি; আমাকে একান্ত ভক্তিযোগে সেবা করিলেই ত্রিগুণাতীত হইয়া ব্রহ্মভাব লাভ করা যায়, কারণ আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা [১৪|২৬,২৭]; ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হইলে আমাতে পরাভক্তি জন্মে [১৮|৫৪] । ‘আমি’ বলিতে অবশ্য এস্থলে বুঝায় ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণ । কিন্তু ভগবানে ও ব্রহ্মে কি কোন পার্থক্য আছে ? আছেও; নাইও । স্বরূপতঃ না থাকিলেও সাধকের নিকট যে পার্থক্য আছে তাহা বুঝা যায় দ্বাদশ অধ্যায়ে অর্জুনের প্রশ্নে – ‘তোমাকে যাঁহারা ত্বদ্‌গতচিত্ত হইয়া ভজনা করেন, আর যাঁহারা অক্ষর ব্রহ্ম চন্তা করেন, এ উভয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সাধক কে ?’ তদুত্তরে শ্রীভগবান্‌ বলিলেন – ‘আমার ভক্তই শ্রেষ্ঠ সাধক, তবে অক্ষর ব্রহ্মচিন্তকেরাও আমাকেই পান ।’ এই কথার মর্ম – অক্ষর ব্রহ্ম আমিই, ব্রহ্মভাব আমারই বিভাব, নির্গুণভাবে আমি অক্ষর ব্রহ্ম, সগুণভাবে আমি বিশ্বরূপ, লীলাভাবে আমি অবতার – আমি পুরুষোত্তমই পরতত্ত্ব । ব্রহ্ম, আত্মা, বিরাট্‌, বৈশ্বানর, তৈজস, প্রাজ্ঞ, তুরীয় – সকলই আমি, সকল অবস্থাই আমার বিভাব বা বিভিন্ন ভাব । এই সগুণ-নির্গুণ, সৃষ্টিস্থিতি-প্রলয়কর্তা, যজ্ঞ-তপস্যার ভোক্তা, সর্বলোকমহেশ্বর পরমাত্মা পুরুষোত্তমই ভগবৎ-তত্ত্ব; আর উহার যে অনির্দেশ্য, অক্ষর, নির্বিশেষ নির্গুণ বিভাব, তাহাই ব্রহ্মতত্ত্ব । এই অর্থে বলা হইয়াছে, আমিই ব্রহ্মের অথবা শাশ্বত ধর্মের প্রতিষ্ঠা ।
সাধনপথে ভক্তির উপযোগিতা স্বীকার করিলেই ভগবত্তত্তের শ্রেষ্ঠতা স্বতঃই আসিবে, এই হেতু গীতা বেদান্তাদি শাস্ত্রের মূলতত্ত্ব স্বীকার করিলেও উহাতে ঈশ্বর-বাদেরই প্রাধান্য । ‘গীতা সাধারণভাবে সেই সেই দর্শনের (সাংখ্য, বেদান্তাদির) মূল প্রতিপাদ্য অঙ্গীকার করিয়া তাহার সহিত ঈশ্বরবাদ সংযুক্ত করিয়া তাহাদিগকে সুসম্পূর্ণ করিয়াছেন । এই ঈশ্বরবাদই গীতার প্রাণ; গীতার আদি, অন্ত, মধ্য – সমস্তই ঈশ্বরবাদে সমুজ্জল ।’ – বেদান্তরত্ন হীরেন্দ্রনাথ, গীতায় ঈশ্বরবাদ ।

BISHWASHWOR ROY. Powered by Blogger.